কুড়িগ্রামে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ায় বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এক মা। সিনিয়র স্টাফ নার্স রিকতা আখতার বানু তার নিজের নামে গড়া প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করান তার মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মনিকে।
১৪ বছর আগে গড়ে তোলা তার স্কুলে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। আর শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ জন। রিকতা আখতার বানু এখনও চাকরির পাশাপাশি বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে জীবন কাটান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালে রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করলেও এমপিওভুক্ত হয় ২০২০ সালে। ‘প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই স্বজন, তাদের সহানুভূতি নয় সহযোগিতা করুন’ কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা এলাকায় গেটে এই মহানুভবতার বাক্য দেখলেই বোঝা যায় প্রতিবন্ধী সন্তানদের জন্য কতটা ভালোবাসা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিদ্যালয়টি।
গেট পেরিয়ে ভেতরে গেলেই দেখা মেলে বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য প্রতিবন্ধী শিশুর। শিশুদের একত্রিত করে পিটি প্যারেড করাচ্ছেন শিক্ষকরা। এরপর বিদ্যালয়ের রুমে রুমে চলছে ক্লাস। শিক্ষার্থীদের বিনোদন দিতে নাচ-গান আর ছড়া-কবিতার আসর চলছে। অনেক অভিভাবক স্কুল ছুটির পর অপেক্ষায় করছেন তার সন্তানের জন্য। স্কুলটিতে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১০ জনের বেতন-ভাতা হলেও বাকিরা এখনও আসতে পারেননি বেতন-ভাতার আওতায়।
স্থানীয়রা জানান, এই বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানরা আসতে পারলে অনেক খুশি হয়। বাড়িতে রাখার চেয়ে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসায় তাদের মানসিক উন্নতি হচ্ছে। অনেক শিশু এখান থেকে স্বাভাবিক পর্যন্ত হয়েছে।
লাভলী বেগম নামের এক অভিভাবক বলেন, আমার সন্তান এই স্কুলে পড়ে। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারত না। খুব দুঃশ্চিতায় ছিলাম। এখানে ভর্তি করার পর সে এখন কথা বলে। আগে আমি নিজেই তাকে স্কুলে নিয়ে আসতাম। এখন আর নিয়ে আসতে হয় না। সে এখন একায় স্কুলে আসে।
মেনেকা বেগম নামের আরও এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ের নাম সাদিয়া সুলতানা। বয়স প্রায় ৯ বছর। অন্য স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করাতে গেছিলাম ভর্তি নেয় নাই। পরে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে এখানে ভর্তি করাইছি। স্কুলের গাড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে বাচ্চাকে নিয়ে আসে। আবার স্কুল শেষ হলে গাড়িতেই বাড়িতে রেখে যায়। স্কুলের সময়টা আমি দুঃশ্চিতামুক্ত থাকি। এই স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে পেরে আমার অনেক উপকার হয়েছে।
রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক সাহিন শাহ বলেন, আমার বিদ্যালয়টিতে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১০ জনের বেতন-ভাতা হলেও বাকিরা এখনও বেতন-ভাতার আওতায় আসতে পারেনি। এ কারণে বাকিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব শিক্ষক কর্মচারী বেতন ভাতার আওতায় এলে শিক্ষার্থীদের অনেক যত্নসহকারে পাঠদান করাতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া প্রতিটি শ্রেণি কক্ষের সমস্যা, ভ্যান, থেরাপি রুম ও ক্রিয়া সামগ্রী নিয়ে কিছুটা সংকট আছে। আমরা শিক্ষক, কর্মচারী, স্থানীয় লোকজন ও প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির সহায়তায় বাচ্চাদের দুপুরে নাস্তা দিয়ে থাকি। সরকার যদি আমাদের স্কুলটিতে দুপুরের নাস্তার ব্যবস্থাটা করতো তাহলে হয়তো বাচ্চারা অনেক উৎসাহ পেত। আর স্কুলের আসার জন্য মনযোগী হতো। আমরা সব বাচ্চাদের নিজের সন্তানের মতো দেখি এবং তাদেরকে নিয়ে চলাফেরা করি।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বলেন, এই বিদ্যালটি কেন প্রতিষ্ঠা করলাম তার পিছনে অনেক কষ্ট আছে। আমার মেয়েকে যখন জেনারেল স্কুলে দিয়েছি, তারা আমার মেয়েকে বের করে দেয়। প্রতিবন্ধী বলে তাকে গালিগালাজও করেছে। তারা তাকে পাগলি বলতো। তারপর আর তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারিনি। সেই থেকে বুকের ভেতর অনেক যন্ত্রণা ছিল।
তিনি আরও বলেন, সেই যন্ত্রণা থেকে আজ আমার এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে স্কুলের বিভিন্ন রকমের সমস্যা আছে। আর বাকি শিক্ষক কর্মচারীকে যদি সরকার বেতন ভাতার আওতায় নিয়ে আসতো তাহলে অনেক ভালো হতো। যে মেয়ের উদ্দেশ্য এই প্রতিষ্ঠান করেছি সেই মেয়ে এখন আমার আগের চেয়ে অনেক সুস্থ। আমার মেয়ে স্কুলে এলে স্কুল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে স্কুল থেকে যাবে না। আর সে এতো পরিমাণে আনন্দে থাকে তা দেখে আমার মন ভরে যায়। একট কথা কি জানেন, প্রতিবন্ধী সন্তানকে সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন পড়াতে চায় না সেই অপমানের কষ্ট একমাত্র মা-বাবা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।
বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে এসে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাঈদুল আরিফ জানান, দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব বিশেষায়িত বিদ্যালয় ও বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলায় যে সব বিশেষায়িত বিদ্যালয় আছে সেখানে বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ন শিশুদের পড়াশোনার প্রতি নজর দেওয়ার জন্য সরকারের নির্দেশনা আছে। তাই চিলমারীতে রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি।
ইতোমধ্যে স্কুলটি সরকারি সহায়তার মাধ্যমে এসেছে। এ স্কুলটিকে যেন আরও বেশি সহযোগিতা করা যায় এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সবধরনের সহযোগিতা আমাদের থাকবে। তাছাড়া জেলার সব বিশেষায়িত বিদ্যালয় যেন সঠিক সহযোগিতা পায় এবং তারা যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে পারে সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সবধরনের সহযোগিতা থাকবে।