শিল্পী মর্যাদা যেন অধরা
বিশদভাবে বললেন মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার কথায়, ‘তরুণ যে নায়ক-নায়িকারা আছেন, ইউটিউব, সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়; তাদেরও ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট আছে। রূপসজ্জা শিল্পী হিসেবে কাকে নিতে হবে— তারাও বলে দেন পরিচালককে। পরিচালকদের কিছু করার থাকে না। নির্মাতাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকার কথা থাকলেও এখনকার পরিচালকদের কোমরভাঙা। মেকআপ আর্টিস্ট, লাইট, প্রোডাকশনে নায়ক-নায়িকারা যদের নিতে বলেন পরিচালকরা তাই নিচ্ছেন। কারণ নির্মাতারা তাদের কাছে জিম্মি। ওই জায়গা থেকে মেকআপ আর্টিস্টকে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু মেকআপ আর্টিস্ট না, টেকনিশিয়ানদেরও মূল্যায়ন নেই এখানে।’
তিনি মনে করেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব এ অবমূল্যায়নের কারণ। এ রূপসজ্জা শিল্পী বলেন, ‘শিক্ষিত হয়ে আমাদের লাইনে খুব একটা কেউ আসে না। মেকআপে পড়ে কেউ মেকআপে আসে না। লাইটসহ অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও তাই। শিখে পড়ে এলে হয়তো এই অবমূল্যায়নের শিকার হতে হতো না।’
প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই
একজন মেকআপ আর্টিস্টকে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কও প্রভাব ফেলে। এরকম উল্লেখ করে মানিক বলেন, ‘ধরুন আমি যার কাজ করছি তার সঙ্গে কোনো কারণে মনোমালিন্য থাকলে কাজটা ঠিকভাবে করতে পারি না। যত ভালো মেকআপ-ই করি তার কাছে ভালো লাগবে না। অন্যদিকে নায়ক-নায়িকা যদি সমর্থন করে তাহলে কাজ এমনিতেই ভালো হয়। এছাড়া মেকআপ আর্টিস্টকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত সম্পর্কটা গুরুত্ব পায় বেশি। অনেক সিনিয়র আর্টিস্টকে গুরুত্ব-ই দেওয়া হয় না।’
প্রতিবন্ধকতার আরও একটি উদাহরণ টেনে জাহাঙ্গীর বলেন, কিছু প্রতারক আছে কাজ করিয়ে পারিশ্রমিক দেয় না। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। তারমধ্যে এরকম হলে জীবনযাত্রায় খুব প্রভাব পড়ে। অনেক সময় মানসম্মানের ভয়ে বলা হয় না। মুখ খুললে কাজ হারানোর ভয়ও থাকে। কারণ এখন অধিকাংশ নায়ক নায়িকাদের ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট থাকে। এরমধ্যে যে দুই-তিনটা কাজ বাইরে থেকে পাওয়া যায় সেটিও যদি না মেলে! সে কারণে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। এই ভোগান্তি সবাই পোহায়। সিনিয়র-জুনিয়র নেই।’
জাহাঙ্গীরের জানান, জুনিয়র মেকআপ আর্টিস্টদের প্রতিবন্ধকতা আরও বেশি। তার কথায়, ‘জুনিয়ররা বেশি ভোগে। কিন্তু বলতে পারে না। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।’
পারিশ্রমিকের বড় অংশ যায় উপকরণ কিনতে
‘একটি সিনেমা করতে গেলে পারিশ্রমিক লাগবে ৫০ হাজার। কিন্তু দেওয়া হয় দশ হাজার। তখন মেকআপের জিনিসগুলো কিনতে পারি না। আবার ধরুন কোনো কাজের পাঁচ দিন শুটিং হলো। এরপর শুরু টাকার সংকট। কিন্তু মেকাপের উপকরণ কিনতে টাকা লাগে। ভালো জিনিস চাবেন টাকা দেবেন না— তাহলে তো হবে না। এই বাজারে মেকআপের উপকরণের অনেক দাম। ভালো ব্র্যান্ডের মেকআপ ব্যবহার করে দিনশেষে আমাদের কিছু থাকে না। সমান সমান হয়।’ এভাবেই বলেন মানিক।
বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত রূপসজ্জা শিল্পী মো. খোকন মোল্লা। তার কথায়, ‘একজন মেকআপ আর্টিস্টকে যদি চার হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয় সেখান থেকে তার সহকারীকে বিল দিতে হয় এক হাজার। ব্যক্তিগত খরচ পাঁচ শ, ম্যাটেরিয়াল খরচ এক হাজার। আড়াই হাজার কিন্তু চলে গেল। এরপর তার কাছে যে অর্থ থাকে আদৌ কি তাতে ভালো মানের কিছু পাওয়া যাবে! তখন সে বাধ্য হবে সস্তার মেকআপ কিনতে। যা দিয়ে কখনোই ভালো কিছু আশা করা যায় না। ভালো কিছু পেতে হলে বাজেট বাড়িয়ে হলেও মেকআপ আর্টিস্টদের পারিশ্রমিক বাড়ানো উচিত। কেননা এটা মানুষের ত্বকের সঙ্গে সম্পর্কিত। পর্দায় অভিনয়শিল্পীকে এর মাধ্যমেই মেলে ধরা হয়। অতএব বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।’
মেলে না কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক
অভিজ্ঞ এ তিন মেকআপ আর্টিস্ট মনে করছেন দেশে রূপসজ্জা শিল্পীরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান না। মানিক বলেন, ‘সিনেমার ক্ষেত্রে একজন সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্টের দৈনিক দশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক হওয়া উচিত। তাহলে মাসে দশ দিন কাজ করলেও ভালোভাবে চলতে পারবে। তা না হলে এই শহরে জীবনধারণ কষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে নতুনদের জন্য। কেননা সবকিছুর দাম বেশি। এই শহরে পরিবার নিয়ে মেকআপ আর্টিস্টদের জীবন সংগ্রাম কঠিন।’
তবে খোকনের কথায়, ‘পারিশ্রমিক যার যার যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। যে যেমন উপযুক্ত তাকে সেরকম দেওয়া হয়। তবে নতুনদের ক্ষেত্রে বাড়ানো উচিত। ন্যূনতম পাঁচ হাজার করা উচিত। সেইসঙ্গে রূপসজ্জা শিল্পীদের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক এক লাখ হওয়া উচিত।’
মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর বলেন, ‘জুনিয়র যারা আছেন তারা পারিশ্রমিক যা পান তা দিয়ে পরিবার নিয়ে এই শহরে চলা খুব কষ্টের। আমি সভাপতি হওয়ার পর পারিশ্রমিক কিছু বেড়েছে। একইসঙ্গে এই মেকআপ আর্টিস্ট মনে করছেন কাজের পরিধি বাড়লেও পারিশ্রমিকের জায়গা সেভাবে উন্নত হয়নি।তিনি বলেন, ‘এখন ঘরে ঘরে ইউটিউব চ্যানেল। এতে কাজ বেড়েছে কিন্তু বাজেট কমেছে। ফলে এখান থেকে কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে ওটিটি মাধ্যম, বিজ্ঞাপনে ভালো বাজেট থাকে। সেখানে ভালো পারিশ্রমিক দেয়।’
মানা হয় না কর্মঘণ্টা
রাত দিন এক করে কাজ করেন রূপসজ্জা শিল্পীরা। দিনশেষে মেলে না ফুরসৎ। অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি কর্মঘণ্টা মেনে কাজ করা। বিষয়টি নিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও) নামে আমাদের একটা সংগঠন হয়েছিল। সংঠনটির মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলাম কর্মঘণ্টা মেনে কাজ করতে। কিন্তু সম্ভব হয় না। বাজেটজনিত জটিলতা থাকে। দেখা যায়, একটি কাজের বাজেটের অর্ধেকই যায় নায়কের পারিশ্রমিক হিসেবে। আরও খরচ থাকে। সবমিলিয়ে পরিচালক পড়েন বিপদে। তিন দিনের কাজ একদিকে শেষ করতে হয়। তখন দিনরাত এক করে কাজ করতে হয় আমাদের। রাতভর কাজ করি সকালে ছাড়ে। নাইট বিলও পাই না। এই দুর্ভোগ নতুনরা বেশি ভোগ করে। এছাড়া দেখা যায় শুটিংয়ের কলাকুশলীরা এসে বসে আছেন সকাল থেকে, আর্টিস্ট আসতে আসতে বিকেল তিন-চারটা। দিন-ই তো চলে যায়, কর্মঘণ্টা মানব কীভাবে।’
তবে আশাবাদী খোকনের কথায়, ‘এই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। শুটিং স্পটে একজন মেকআপ আর্টিস্ট যখন থেকে কাজ শুরু করবেন তখন থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কল টাইম। আশা করি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এখন চেষ্টা চলছে। তবে অনেক সময় মেইনটেন করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ফেঁসে যাওয়া কাজের ক্ষেত্রে। পরিচালকের বাজেট কম থাকে তখন সবাই মিলে কাজটা সম্পন্ন করে দিতে হয়।’
বোঝাপড়ার অভাব
রূপসজ্জাশিল্পীদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে বোঝাপড়ার অভাব। যা তাদের চলার পথে আরও একটি অন্তরায়। বিষয়টি জাহাঙ্গীর বোঝান একটি ঘটনার মাধ্যমে। তার কথায়, ‘আমি সভাপতি থাকাকালীন একটি ঘটনা বলি। বড় এক প্রোডাকশন হাউজে এক মেকআপ আর্টিস্টের বেশ কিছু টাকা আটকে ছিল। ওই মেকআপ আর্টিস্ট আমাকে বলল, আমার টাকা না দিয়ে তারা অন্য মেকআপ আর্টিস্ট নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম তার ১৫-২০ হাজার টাকার মতো বকেয়া। এরমধ্যে আরেকজন মেকআপ আর্টিস্ট কাজ করছে। অথচ তার দুইদিন আগে আমরা মিটিংয়ে বলেছিলাম কারও ছুটে যাওয়া কিংবা ফেঁসে যাওয়া কাজ অন্য কেউ ধরব না। আমাদের তো নিজেদেরই ঠিক নাই। এটা আমাদের জন্য বড় একটি সমস্যা।’
নিজস্ব জায়গা চান মেকআপ আর্টিস্টরা
মেকআপ আর্টিস্টদের নেতা জাহাঙ্গীর মনে করেন তাদের একটি জায়গা প্রয়োজন। বলেন, ‘‘আমরা আছি ‘দড়ি ছেড়া গরু’র মতো। নিজস্ব জায়গা নেই। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)র মতো আমাদেরও যদি একটা জায়গা থাকত তাহলে সবাইকে এক জায়গায় পাওয়া যেত। নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে একত্রিত হতে পারতাম।’’