দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রত্যাশিত মাত্রায় যেমন ঠেকানো যাচ্ছে না, তেমনি মৃত্যুও ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। আগের তুলনায় আক্রান্তদের মধ্যে জটিলতা বাড়ছে, হাসপাতালে ভর্তির হার বাড়ছে আর মৃত্যুও বেড়েই চলছে। ফলে এখন মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি ঠেকানোই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এখন পর্যন্ত একই ধারায় বয়স্করাই মারা যাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। সেদিকে নজর রেখে সরকারও মৃত্যু ঠেকানোর চূড়ান্ত কৌশল হিসেবেই আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠোর লকডাউন কার্যকর করছে। তেমনি হাসপাতাল সুবিধা ও টিকা কার্যক্রম জোরালো করারও বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে যে হারে রোগী বাড়ছে, সেটা থামানো না গেলে সামনে দেশের সব সক্ষমতা কাজে লাগিয়েও কূল পাওয়া যাবে না বলে বারবারই সতর্ক করা হচ্ছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। এরই মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় এমন উদাহরণও তৈরি হয়েছে। অনেক জেলায় রোগীর চাপ সামলানোর উপায় মিলছে না। মানুষের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মাঠ পর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা, অক্সিজেন সরবরাহ ও ভেন্টিলেটরের সংকট। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, অনেক হাসপাতালে আধুনিক প্রযুক্তি বা আইসিইউ ব্যবস্থা থাকলেও নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ জনবল। জনবলসংকটও চিকিৎসাসেবার জন্য এখন বড় এক হুমকি হয়ে আছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সবার আগে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে আক্রান্তদের খুঁজে বের করে তাদের ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা। অর্থাৎ যারাই শনাক্ত হচ্ছে, তাদের প্রত্যেককে আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে এবং যাদের ন্যূনতম জটিলতা থাকবে, তাদের হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকার তুলনায় এখন ঢাকার বাইরে মফস্বল এলাকায় বেশি নজর দিতে হবে। এলাকায় এলাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ মেডিক্যাল টিম মাঠে নামাতে হবে। যেসব এলাকায় ঘরে ঘরে উপসর্গ দেখা যায়, সেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা বিশেষ বুথ বসিয়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে, রেজাল্ট পজিটিভ হলে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি এলাকায় বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে। এসব কাজে স্থানীয় কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে হলেও প্রতিদিন মনিটর করতে হবে। তা না করলে একদিকে যেমন সংক্রমণের দ্রুত বিস্তার ঘটবে, তেমনি মৃত্যুও বাড়তে থাকবে। চাপ আরো বাড়বে হাসপাতালের ওপর, যা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
ডা. মুশতাক বলেন, এখন যতটুকু ব্যবস্থা চলছে তাতে হয়তো দুই সপ্তাহের মাথায় সংক্রমণ কমে আসবে এবং তিন সপ্তাহের মাথায় মৃত্যু এমনিতেই কমবে। আর যদি ব্যবস্থাগুলো কার্যকর না হয়, তবে দুটিই আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। কভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংক্রমণ কমানোর জন্য অন্যতম উপায় হিসেবে আমরা সবাইকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু শুধু ঘরে থাকলেই হবে না। ঘরে কারো মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলেই তাকে অবশ্যই আইসোলেশনে থাকতে হবে। বয়স্ক কেউ থাকলে তাঁকে অবশ্যই বেশি সতর্কতার মধ্যে রেখে হাসপাতালে নিতে হবে। অন্যদের মাস্ক পরতে হবে ঘরের মধ্যেই। সবারই পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কারো পজিটিভ রেজাল্ট এলে নিয়মিত অক্সিজেন লেভেল মাপতে হবে এবং জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘এককথায় বলতে গেলে কয়েক দিন ধরে যে হারে রোগী বাড়ছে, সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্য দেশে যেমন বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছে এখানেও তা-ই দেখতে হতে পারে।’ মানুষের সতর্কতাই সবচেয়ে বড় বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দেশে যাদের মৃত্যু ঘটছে তাদের মধ্যে প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশই পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ। তাদের যদি আমরা নিরাপদে রাখতে পারি, তবেই মৃত্যু কমে যাবে।’
মহাপরিচালকের কথার সূত্রে তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মারা যাওয়া ১৪ হাজার ৭৭৮ জনের মধ্যে ৮০.২৪ শতাংশ বা ১১ হাজার ৮৫৮ জনের বয়স ৫১ বছরের বেশি। অন্যদিকে ৪১-৫০ বছরের ১১.৩৪ শতাংশ, ৩১-৪০ বছরের ৫.৫১ শতাংশ, ২১-৩০ বছরের ১.৯০ শতাংশ, ১১-২০ বছরের .৬৬ শতাংশ ও ১০ বছরের নিচের .৩৫ শতাংশ মারা গেছে। পঞ্চাশোর্ধ্বদের সর্বোচ্চ মৃত্যু হলেও সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছেন ২৫-৩৪ বছর বয়সীরা।
ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবীণদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। টিকার যে সংকটে আমরা পড়েছিলাম, তা এখন অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। এ মাসের মধ্যে অনেক টিকা আসবে। আজ ও কাল (গতকাল ও আজ) আসছে ৪৫ লাখ, এরপর শিগগিরই কোভ্যাক্স থেকে আসবে অক্সফোর্ড-আস্ট্র্যাজেনেকার আরো ১০ লাখ ডোজ। এ ছাড়া চীন ও রাশিয়া থেকে আরো টিকা আনার প্রস্তুতি চলছে। ফলে লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি আর টিকা একসঙ্গে চালাতে পারলে বয়স্ক মানুষদের সুরক্ষা করা গেলে মৃত্যু কমে আসবে।’
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মহাপরিচালক বলেন, এখন শুধু ঢাকায়ই নয়, উপজেলায়ও অক্সিজেন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেকেই করোনাকে পাত্তা দিচ্ছে না। প্রচারেও তারা কান দেয় না। উপসর্গ দেখা দিলেও তারা পরীক্ষা করাতে চায় না, হাসপাতালেও আসতে চায় না। এই ধরনের মানুষের মধ্যে যাঁরা বয়স্ক এবং আগে থেকে যাঁদের অন্যান্য রোগের জটিলতা রয়েছে, তাঁরা অনেকে বাড়িতে মারা যাচ্ছেন। অনেকে এমন সময় হাসপাতালে আসছেন, যখন আর কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করেও শেষরক্ষা হয় না। আবার কোথাও রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাত্ক্ষণিক হয়তো কিছু কারিগরি সমস্যাও হচ্ছে। সেটা মেটাতে মেটাতে হয়তো অনেকের ক্ষতি হয়ে যায়। এ জন্য বয়স্কদের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলেই দেরি না করে কাছের হাসপাতালে নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা থেকে জানা গেছে, এখন দেশের ১২ হাজার ৮০২টি সাধারণ শয্যা, এক হাজার ১৫০টি আইসিইউ শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডার ২৪ হাজার ১৯২টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এক হাজার ৬৪২টি, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর আছে এক হাজার ৬৪২টি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) আরো কিছু জমা আছে।
তবে গতকাল অতিরিক্ত সচিব ও সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামা বলেন, ‘আমার হাতে এখন ১১০টি আইসিইউ শয্যা, ৭০০ অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ও পাঁচ হাজার সিলিন্ডার জমা আছে। এগুলো যেখানে যেখানে দরকার সেখানে দেওয়া যাবে। তবে এখন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ভেন্টিলেটর নেই। এ সপ্তাহের মধ্যেই সেগুলো কেনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ভেন্টিলেটর হাতে পাওয়া যাবে।’
হাসপাতালে জনবলসংকট নিয়েও উদ্বেগে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালনকারীদের এমনিতেই দুই সপ্তাহ করে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় বলে ওই অংশটির এক ধরনের ঘাটতি থাকে। এ ছাড়া একটানা দেড় বছর ধরেও দায়িত্ব পালন করতে করতে বাকিরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। আবার নানা জটিলতায় বারবার আটকে যাচ্ছে কিছু কিছু নিয়োগ। এমনকি সর্বশেষ বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসক যোগদানই করেননি। এ ছাড়া দেশে আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের এমনিতেই ঘাটতি রয়েছে। ফলে জনবলের সংকট তো হচ্ছেই। করোনা রোগীদের সেবায় তো এর প্রভাব পড়তেই পারে। মাঠ পর্যায়ে এ সংকট আরো বেশি। তিনি বলেন, ‘আমরা জনবল নিয়োগের জন্য এরই মধ্যে আবারও কাজ শুরু করেছি।’