মৃত্যুর মিছিলে একে একে যোগ হয়েছে ১০ হাজার ৮১ জনের নাম। চিকিৎসক, রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ এমন কোন পেশা নেই যাদের নাম নেই এই তালিকায়। এক একটি মানুষের মৃত্যু এক একটি পরিবারে অসীম শূন্যতা। সীমাহীন শোক। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হারিয়ে বড় শূন্যতায় পড়েছে এক একটি খাত। দিন দিন ভারি হচ্ছে শোকাতুর মানুষের কান্না। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। শোকাহত পুরো জাতি।
গত বছরের ৮ই মার্চ দেশে যখন করোনাভাইরাস হানা দিয়েছিল তখন কে জানতো তা এতটা আগ্রাসী আর প্রাণঘাতী হবে। বছরের শেষে যখন প্রকোপ কমে আসে তখন কে ভেবেছে তা আরো আগ্রাসী রূপ নিয়ে হানা দেবে দ্বিতীয় দফায়। এখন প্রতিদিনই করোনা কেড়ে নিচ্ছে প্রায় শতাধিক প্রাণ। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হাজারো মানুষ। প্রিয়জনকে বাঁচানোর যুদ্ধে হাজার হাজার স্বজনের বিনিদ্র দিন কাটছে হাসপাতালে। হাসপাতাল, শয্যা খুঁজে পেতে মানুষের দৌড়ঝাঁপ। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্ত যুদ্ধের মধ্যেই হেরে যাচ্ছেন অনেকে। অনন্ত অসীমের পথে তাদের যাত্রায় শোকে পাথর হচ্ছেন স্বজনরা।
গত বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিশিষ্টজনদের মধ্যে করোনার চিকিৎসক সিলেটে গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত ডা. মো. মঈন উদ্দিন মারা যান এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। এরপর একে একে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ার, আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক এমপি হাজী মকবুল হোসেন, বাংলাদেশি শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইমামুল কবীর শান্ত, খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাবেক অর্থ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল কবির তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব বজলুল করিম চৌধুরী, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিফ হেমোটোলজিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান, হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এমাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বিশিষ্ট শিল্পপতি এম এ হাসেম, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, শিল্পোদ্যোক্তা আবদুল মোনেম, সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা, শিল্পনির্দেশক ও অভিনেতা মহিউদ্দীন ফারুক, শিক্ষাবিদ সুফিয়া আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের নবম চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন প্রমুখ। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম, মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকন, সাংবাদিক নেতা ও এনটিভির যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুস শহীদ। সংস্কৃতি অঙ্গনে আরো অনেক গুণীজনকে হারিয়েছি আমরা। তাদের মধ্যে আলী যাকের, মিতা হক, ফরিদ আহমেদ, জানে আলমসহ আরো অনেকে রয়েছেন।
আরো ৯৪ জনের মৃত্যু: দেশে করোনার মৃত্যুর মিছিল দ্রুতই দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরো ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাবে দেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ১০ হাজারের বিষাদময় মাইলফলক ছাড়ালো। বছরের শেষদিকে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এলেও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর এখন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। দেশে গত বছরের ৮ই মার্চ করোনা রোগী শনাক্ত হলেও ভাইরাসটিতে প্রথম মৃত্যুবরণ করে ১৮ই মার্চ। সেই হিসাবে এক বছর ২৮ দিনে মৃত্যুর এই সংখ্যা দাঁড়ালো। নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ১৯২ জন। এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ জন। একদিনে ৫ হাজার ৯১৫ জন সুস্থ হয়েছেন। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ জন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর গত ১৫ দিনেই ১ হাজার ৩৫ জন করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। প্রথম মৃত্যুর আড়াই মাস পর গত বছরের ১০ই জুন মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়েছিল। এরপর ৫ই জুলাই ২ হাজার, ২৮শে জুলাই ৩ হাজার, ২৫শে আগাস্ট ৪ হাজার, ২২শে সেপ্টেম্বর ৫ হাজার ছাড়ায় মৃতের সংখ্যা। এরপর কমে আসে মৃত্যুর বাড়ার গতি। ৪ঠা নভেম্বর ৬ হাজার, ১২শে ডিসেম্বর ৭ হাজারের ঘর ছাড়ায় মৃত্যুর সংখ্যা। এ বছরের ২৩শে জানুয়ারি ৮ হাজার এবং ৩১শে মার্চ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছিল। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দিনে ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে গত ৭ই এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত রোগীর হার ২১ শতাংশ। এই পর্যন্ত শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮৩। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। শনাক্ত রোগীদের মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৫৭টি ল্যাবে ১৯ হাজার ৯৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৫৭২টি নমুনা। গত একদিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৬৪ জন পুরুষ আর নারী ৩০ জন। তাদের মধ্যে ৪ জন বাসায় মারা গেছেন। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। এ পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে ৭ হাজার ৪৯৯ জনই পুরুষ এবং ২ হাজার ৫৮২ জন নারী। মৃতদের মধ্যে ৫২ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ২৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, ১৪ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর এবং ৩ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ৬৯ জন ঢাকা বিভাগের, ১২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৬ জন রাজশাহী বিভাগের, ৩ খুলনা বিভাগের, ২ জন বরিশাল বিভাগের, ১ জন করে সিলেট ও রংপুর বিভাগে রয়েছেন।
টিকা দেয়া হয়েছে ৬৬ লাখ ডোজ: দেশে ৬ষ্ঠ দিনে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৭৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে নিয়েছেন ২৯ হাজার ৩২৪ জন। এ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৯ লাখ ৩০ হাজার ১৫১ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় মিলে টিকা দেয়া হয়েছে ৬৬ লাখ ১৭ হাজার ৩৬ ডোজ।
অন্যদিকে সারা দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর ৫৫তম দিনে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১০ হাজার ৫৭২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নিয়েছেন ২ হাজার ১৭২ জন। এ পর্যন্ত দেশে মোট প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৫ লাখ ২৫ হাজার ৯৮৯ জন এবং নারী ২১ লাখ ৬০ হাজার ৮৯৬ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মোট ৯৬৩ জনের। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে অনলাইনে মোট নিবন্ধন করেছেন ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬৯ জন। গত ২৭শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে। আর দ্বিতীয় ডোজ শুরু হয় ৮ই এপ্রিল থেকে।