বৈশ্বিক কৃষি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা রয়েছে ভারতের। সম্প্রতি দেশটিতে খাদ্যপণ্যের দাম ১১ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর জন্য আবহাওয়াজনিত কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত একশো বছরের মধ্যে ভারতের শুষ্কতম আগস্ট গেছে এবার।
দেশটিতে টমেটোর দাম কমতে শুরু করলেও জুন থেকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
একইভাবে চলতি বছরের শুরুর তুলনায় ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
এই বছর কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে এবং আগামী বছরের গ্রীষ্মে লোকসভা নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত সরকার খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা
২০২২ সালের মে মাসে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পরে, সরকার গত মাসে নন-বাসমতি চাল রপ্তানিও নিষিদ্ধ করে।
রপ্তানি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের ওপর ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর চিনির উৎপাদনও কম হতে পারে।
কেয়ারএজ গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ রজনী সিনহা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে চিনি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনাও বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামীতে সরকার আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।
রপ্তানির ওপর বারবার বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও দেশের অভ্যন্তরে চালের বর্ধিত দাম কমেনি।
বৈশ্বিক আর্থিক গোষ্ঠী নোমুরা সম্প্রতি প্রকাশিত এক নোটে বলেছে, এমন পরিস্থিতিতে এখন সরকার আরও বড় ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে।
বিশ্বেও এর প্রভাব
অভ্যন্তরীণ মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভারতের আগ্রাসী প্রতিরক্ষামূলক কৌশল কি বিশ্বে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হুমকি দিচ্ছে?
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) মনে করে, বিশেষ করে চাল, চিনি ও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে। গত এক দশকে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এর মার্কেট শেয়ার ৪০ শতাংশ। এটি চিনি এবং পেঁয়াজের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) চালের মূল্য সূচক জুলাই মাসে ২.৮ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ।
দাম বাড়ার বেশির ভাগই ইন্ডিকা জাতের চালের কারণে, যার রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।
এর ফলে অন্যান্য অঞ্চলেও চালের দামের ওপর চাপ পড়েছে বলে জানিয়েছে এফএও।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জোসেফ ডব্লিউ গ্লোবার বলেন, গত মাসে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে থাই চালের দামও ২০ শতাংশ বেড়েছে।
এই মূল্য বৃদ্ধি বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। এফএও এবং জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি দ্বারা চিহ্নিত ক্ষুধায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১৮টি হটস্পটে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়তে পারে।
ভারতের উপর নির্ভরতা
চাল এশিয়া ও আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রধান খাদ্য এবং তাদের শক্তির চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারত এই জায়গাগুলোর প্রধান রপ্তানিকারক।
এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার ৪২টি দেশ তাদের চালের ৫০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করে। আইএফপিআরআই-এর মতে, কিছু দেশে এটি ৮০ শতাংশের মতো এবং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বা পাকিস্তানের মতো অন্যান্য বড় চাল উৎপাদনকারীরা এর ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না।
বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি বিভিন্ন দেশেও প্রভাব ফেলবে। এফএও’র মার্কেটস অ্যান্ড ট্রেড ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ উপালি গালকেটির মতে, এই দেশগুলোকে আমদানিতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে, যার জন্য তাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ব্যবহার করতে হবে। এতে তাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য যেমন বিঘ্নিত হবে, তেমনি মুদ্রাস্ফীতিও বাড়বে।
ভারত কি এর জন্য দায়ী?
তবে বিশ্বজুড়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য একা ভারতের নেওয়া পদক্ষেপকে দায়ী করা যায় না। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা, বিশ্বজুড়ে খারাপ আবহাওয়া এবং ‘ব্ল্যাক সি গ্রেন ইনিশিয়েটিভ’-এর অবসানও এতে ভূমিকা রেখেছে।
কৃষ্ণ সাগর শস্য উদ্যোগ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউক্রেনের বন্দর থেকে অন্যান্য দেশে শস্যের নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য একটি চুক্তি। রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক এবং জাতিসংঘের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
উপালি গালকেটি বলেন, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম কমেছে, কিন্তু বাজারে প্রভাব ফেলছে এমন অন্যান্য কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
চীনসহ বিশ্বের অনেক অংশে মন্দা সত্ত্বেও বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঐতিহাসিক পর্যায়ে রয়েছে। এই অঞ্চলে চাহিদা হ্রাস আন্তর্জাতিক খাদ্য মূল্যের উপরও প্রভাব ফেলেছে।
তেল ও শস্যের দাম কম থাকায় বিশ্বব্যাংক আশা করছে, ২০২৩ সালে তাদের খাদ্যমূল্য সূচক ২০২২ সালের তুলনায় কম হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে খাদ্যের দাম নির্ভর করবে এল নিনোর প্রভাবের ওপর। এর প্রভাব অনেক বড় হবে এবং খাদ্য বাজারে আরও চাপ পড়তে পারে।
ভারতের ‘ইমেজের ওপর প্রভাব’
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অনেক ফোরাম ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।
রপ্তানি বিধিনিষেধ শুধু বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বাড়ায়নি, নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে এর ফলে কৃষকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এফএও’র মতে, সবচেয়ে বড় বিপদ দেখা দেবে যখন অন্যান্য দেশও তাদের দেশের খাদ্যপণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করবে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমিয়ে দেবে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সংকল্পের কারণে ভারত এসব দিক বিবেচনা করবে না।
ভারতে ফসলের দাম বৃদ্ধি অতীতে নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যেমন, পেঁয়াজের দামের কারণে ক্ষমতাসীন দলগুলোকে নির্বাচনে পরাজয়ের মুখে পড়তে হয়।
সাধারণ ভারতীয়দের আয়ের একটি বড় অংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করা হয়। এমতাবস্থায় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আসন্ন উৎসব মৌসুমে মানুষের খরচ করার মতো অর্থ কম থাকবে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই ইতিমধ্যে ছয়বার সুদের হার বাড়িয়েছে। যেহেতু স্বল্প সরবরাহের কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাই আরবিআইয়ের কাছে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব কম অবশিষ্ট রয়েছে।
এমতাবস্থায় বাণিজ্যে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই।
কেয়ারএজ গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ রজনী সিনহা বলেন, এই সময়ে সব দেশের ফোকাস তাদের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। আমি বলব যে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার আগে ভারতকেও তার স্বার্থের দিকে তাকাতে হবে।