২০২৩ সালের নভেম্বরে ব্রিটেন থেকে একটি ‘ব্র্যান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার পি ৪০০ অটো বায়োগ্রাফি হাইব্রিড জিপ’ আমদানি হয়। ২০২৩ মডেলের ২৯৯৬ সিসির গাড়িটির বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হলে খালাস স্থগিত হয়। গাড়িটি মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করে অটো মিউজিয়াম নামের একজন আমদানিকারক। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এআইআর ও এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তারা শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে দেখতে পায়— গাড়িটি ৬ সিলিন্ডারের পেট্রোল ইঞ্জিন দ্বারা চালিত। যার সঙ্গে ৪৮ভি মাইল্ড হাইব্রিড টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। মাইল্ড গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট বা স্টপের কাজ করে। একই ধরনের বিলাসবহুল দুটি গাড়িকে হাইব্রিড ঘোষণা দেওয়ার কারণে ১৩ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়।
ব্যবসায়ীরা এরূপ গাড়িকে হাইব্রিড ঘোষণা দিলেও ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসিও) নির্দেশনা অনুযায়ী এনবিআর মনে করে এগুলো মাইল্ড নন-হাইব্রিড গাড়ি। হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড গাড়ির এইচএস কোডের জটিলতায় বন্দরে একই ধরনের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি পড়ে রয়েছে বলে জানা যায়। গত চার বছরে পরিবেশবান্ধব ঘোষণায় এইচএস কোড সুবিধা নিয়ে অবাধে বিলাসবহুল গাড়ি হাইব্রিড ঘোষণায় এসেছে। এরূপ শুল্ক ফাঁকি রোধে গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের বাজেটে নতুন কিছু শর্ত যোগ করতে যাচ্ছে সরকার।
জানা যায়, হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড নিয়ে এইচএসকোড পরিবর্তন হবে না, অর্থাৎ শুল্কের হারে কোনো পরিবর্তন ছাড়া কিছু শর্ত এইচএসকোডের সঙ্গে যোগ করা হবে, যাতে কোনো আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করতে না পারে। যার মধ্যে রয়েছে হাইব্রিড ও নন হাইব্রিড সংজ্ঞা আরো সুনির্দিষ্ট করা, যে দেশ থেকে আমদানি হবে সেখানকার ঘোষণাপত্র, বিলাসবহুল গাড়ির মূল্য বিবেচনা করা এবং পরিবেশবান্ধব কি না, সে বিষয়ে ছাড়পত্র যাচাই করা ইত্যাদি। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও পরিবেশবান্ধব বিবেচনায় নিয়ে হাইব্রিড গাড়িতে যে কারণে শুল্ক কমানো হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যের প্রকৃত বাস্তবায়ন।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে যেটা হচ্ছে হাইব্রিড ঘোষণা দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করছে একটি গোষ্ঠী, যা আসলে উচ্চবিত্তরা ক্রয় করছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি কোটি টাকার বাড়ি ব্যবহার করে না। এতে একদিকে যেমন সরকার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণায় বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে দেশীয় গাড়ি শিল্পের সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য দেশেই আন্তর্জাতিক মানের গাড়ি উৎপাদন হোক, তাতে শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের নতুন দাঁড় উন্মোচন হবে। এসব কারণে হাইব্রিড ঘোষণায় নন-হাইব্রিড গাড়ি যেন আমদানি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষ ডব্লিউসও’র গাইডলাইন অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য।
সাধারণত হাইব্রিড ও বিলাসবহুল নন-হাইব্রিড গাড়ির শুল্কের পার্থক্য দুই থেকে তিনগুণ হয়ে থাকে। যেমন- আটককৃত ২৯৯৬ সিসির হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক পরিশোধ হয়েছিল ২২১ শতাংশ। কিন্তু একই সিসির নন-হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক হবে ৪৩০ শতাংশ।
হাইব্রিড গাড়ি কী?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের সমন্বয়ে চালিত যানবাহন হলো হাইব্রিড গাড়ি। এই গাড়িগুলোতে প্রাথমিক শক্তি হিসেবে ব্যাটারি এবং দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। দুই শক্তি গাড়ির প্রয়োজন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। পাওয়ার কন্ট্রোল ইউনিট বা পিসিইউ নামের অত্যাধুনিক এক যন্ত্র এই পুরো কাজ করে থাকে। সাধারণ গাড়িতে জ্বালানি তেলের যে অপচয় হয়, হাইব্রিড গাড়িতে সে অপচয় বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ গাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য জ্বালানিসাশ্রয়ী। সাধারণ গাড়ি ১ লিটার তেলে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, হাইব্রিড গাড়ি স্বভাবত তার চেয়ে ৭ থেকে ৯ কিলোমিটার রাস্তা বেশি অতিক্রম করে। অন্যদিকে হাইব্রিড গাড়ি যখন ব্যাটারি শক্তিতে পরিচালিত হয়, তখন ইঞ্জিন বন্ধ থাকে। গাড়ি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডও কম নির্গত হয়। ফলে পরিবেশ দূষণের হার কমে।
ব্র্যান্ড নিউ এবং রিকন্ডিশন্ড উভয় ক্যাটাগরিতে হাইব্রিড গাড়ি দেশের বাজারে পাওয়া যায়। ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির ক্ষেত্রে বিএমডব্লিউ, টয়োটা, মিতসুবিশি এবং সুজুকির হাইব্রিড গাড়ি রয়েছে। রিকন্ডিশন্ড বাজারে প্রায় প্রতিটি জাপানি অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে হাইব্রিড গাড়ি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে টয়োটা অ্যাকুয়া, এক্সিও, প্রিয়াস, নোয়াহ, আলফার্ড, ভেলফায়ার, এসকোয়ার, কেমরি, সিএইচআর, হোন্ডা ভেজেল, গ্রেস, নিসান এক্সট্রেইলসহ বেশ কয়েকটি মডেলের হাইব্রিড গাড়ি পাওয়া যায়।
নন-হাইব্রিড গাড়ি কী?
নন-হাইব্রিড গাড়ি হলো এমন যানবাহন যা চালনার জন্য শক্তির উৎস একটি। আর জ্বালানি হলো তেল বা ডিজেল। বৈদ্যুতিক মোটর যুক্ত হাইব্রিড বিল্ডের বিপরীতে, নন-হাইব্রিডগুলো সম্পূর্ণরূপে একটি অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ইঞ্জিনের উপর নির্ভর করে। এই গাড়ির মাইলেজ যেমন কম তেমন দামও হাইব্রিড গাড়ির তুলনায় কম। যেহেতু ফুয়েল নির্ভর গাড়ি, কার্বন নিঃসরণের হারও বেশি। অর্থাৎ হাইব্রিডের মতো পরিবেশবান্ধব নয়। এসব বিবেচনায় নন-হাইব্রিড গাড়িতে শুল্কের হার অনেক বেশি নির্ধারণ করা আছে।