বগুড়ার মাহমুদুন্নবী বিপ্লব আবিষ্কার করেছেন এমন এক অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর যন্ত্র, যা দিয়ে মিনিটে ১০ লিটার আর প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ লিটার অক্সিজেন উৎপন্ন সম্ভব। ফলে একসঙ্গে একাধিক শ্বাসকষ্টের রোগীকে অক্সিজেন দেয়া যাবে। কে.আর. অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর নামে এ যন্ত্র করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন যন্ত্র বিজ্ঞানী মাহমুদুন্নবী।
গত জুনে যন্ত্রটি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ টু আই ইনোভেশন ল্যাবে প্রদর্শন করলে সেখানকার আয়োজকরা এর প্রশংসা করেছেন।
মাহমুদুন্নবী বলেন, করোনায় আক্রান্তরা অক্সিজেন সংকটে পড়েন। অথচ আমাদের অক্সিজেনের ঘাটতিও আছে। এসব চিন্তা করেই তিনি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর যন্ত্র আবিষ্কারে লেগে পড়েন। এরপর যন্ত্রটি তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন। এর নাম তিনি দিয়েছেন কে.আর. অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর। যন্ত্রটি আবিষ্কার করতে তার সময় লেগেছে প্রায় এক মাস। খরচ পড়েছে ৭০ হাজার টাকা। যন্ত্রটি দ্বারা প্রতি মিনিটে ১০ লিটার আর প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ লিটার অক্সিজেন উৎপন্ন করা যাবে। ৬০০ লিটার অক্সিজেন উৎপন্ন করতে প্রতি ঘন্টায় বিদ্যুৎ খরচ হবে তিন টাকা। সেই অনুযায়ী প্রতি লিটারে এর দাম পড়বে ০.০০৫ পয়সা। এ যন্ত্রের সাহায্যে একাধিক শ্বাসকষ্টের রোগীকে অক্সিজেন দেয়া সম্ভব।
তিনি আরো জানান, সম্প্রতি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তক এ টু আই ইনোভেশন ল্যাবে অক্সিজেন উৎপাদনের যন্ত্র প্রদর্শনের আহ্বান করা হয়। এরপর গত ১৭ জুন যন্ত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তার উদ্ভাবিত কেআর অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরসহ মোট ছয়টি যন্ত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানে তার আবিষ্কৃত যন্ত্রের প্রশংসা করেন আয়োজকরা।
যন্ত্রটির অক্সিজেন উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মাহমুদুন্নবী বিপ্লব বলেন, বাতাস থেকে যন্ত্রটি ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ বিশুদ্ধ অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষম। তার এই যন্ত্রটি বেশ কিছু উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যন্ত্রটি অক্সিজেন উৎপন্নের জন্য প্রথমে এটি প্রাকৃতিক বাতাস গ্রহণ করে। এরপর যন্ত্রের মাঝে থাকা মনিটরিং সিস্টেমের সাহায্যে বাতাসের মাঝে থেকে নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনকে আলাদা করে। নাইট্রোজেন আদালা করার পর সেটিকে বাতাসে বের করে দিয়ে অক্সিজেন সংগ্রহ করে। এভাবে অক্সিজেন উৎপন্ন হয়। এছাড়া নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন আলাদা করার জন্য যন্ত্রটির মাঝে জিওলাইট কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। যন্ত্রের আকারের উপর জিওলাইটের পরিমাণ নির্ভর করে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ফরেনসিক মেডিসিন) মিজানুর রহমান বলেন, মাহমুদুন্নবীর উদ্ভাবিত যন্ত্রটি আসলেই রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে খুব কার্যকর হবে। মানুষের অক্সিজেন স্যাটারেশন যদি ফল করে ৯০ এর কাছাকাছি আসে বা ৯৫ এর নিচে আসে তখন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। ৮০ শতাংশ স্যাটারেশনেও এই অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর সাপোর্ট দিতে পারবে বলে আমি মনে করি। কোন ব্যক্তির যদি অক্সিজেন স্যাটোরেশন ৯৫ থেকে ৯০ এ নেমে আসে তখন তার প্রতি মিনিটে এক লিটার করে অক্সিজেন লাগে। সেক্ষেত্রে এই যন্ত্র দিয়ে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তিকে অক্সিজেন দেয়া সম্ভব।
মাহমুদুন্নবী বিপ্লবের বাড়ি গাবতলীর পদ্মপাড়া গ্রামে। বর্তমানে বগুড়া শহরের সুত্রাপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তিনি বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৯৪ সালে রেফ্রিজারেশন এবং এয়ারকন্ডিশনিং (পাওয়ার) বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটেই ১৯৯৬ সালে চাকরিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি ২০০২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পলিটেকনিকে চাকরি করার পাশাপাশি বগুড়া শহরের শেরপুর রোডের সূত্রাপুর এলাকায় মেসার্স কাঁকন রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেটিই তিনি পরিচালনা করে আসছেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কারে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রকৌশলী মাহমুদুন্নবী বেশ কয়েকটি যন্ত্র আবিষ্কার করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে- বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এসির পরিবর্তে ব্যবহারযোগ্য ‘ডিসি ভেন্টিলেশন সিস্টেম’, বন্যা পূর্ব সতর্কীকরণ যন্ত্র, ‘বেবী ইউরিন অ্যালার্ম বেড’, রোগীর দেহে পুশ করার ‘স্যালাইন অ্যালার্ম সিস্টেম’, জলজ প্রাণীদের জন্য পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ‘ওয়াটার এ্যারোয়েটর’, করোনা প্রতিরোধে অটোমেটিক স্যানিটাইজিং যন্ত্র, প্যারালাইজড রোগিদের ব্যবহারের জন্য ‘অটোমেটিক হ্যান্ড এক্সারসাইজ’। সর্বশেষ গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নিবির পরিচর্যা ওয়ার্ডে (আইসিইউ) ব্যবহারের জন্য ভেন্টিলেটর যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এর মধ্যে বন্যা পূর্ব সতর্কীকরণ যন্ত্রটি আবিষ্কার করে তিনি ২০১৮ সালে বগুড়ায় ‘ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা’য় শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকের পুরস্কার অর্জন করেন।