ফিলিস্তিনের গাজাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। চলমান এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন ইসরায়েল। আর তা মেনে নিতে হামাসের প্রতি আহবান জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ‘এখন এই যুদ্ধ বন্ধের সময় এসেছে।’
যুদ্ধবিরতির জন্য তিন ধাপের প্রস্তাব দিয়েছে ইসরায়েল। প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি হবে এবং গাজার জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে মানবিক সহায়তা প্রদান করা হবে এবং একইসঙ্গে দুপক্ষের মধ্যে বন্দি এবং জিম্মি বিনিময় হবে। এই চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শত্রুতা বন্ধ এবং গাজায় বড় ধরণের পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে।
হামাস বলেছে, তারা এই প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
শুক্রবার (৩১ মে) হোয়াইট হাউজে এক বক্তব্যে জো বাইডেন বলেছেন, প্রস্তাবিত পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে একটি ‘পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’, সেই সঙ্গে জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের জিম্মি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বাইডেন বলেন, এটা আসলেই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। হামাস সবসময় বলে তারা যুদ্ধবিরতি চায়। তাহলে তারা এই চুক্তি মানে কি—না, সেই বক্তব্য প্রমাণ করার এটি একটি সুযোগ। এই যুদ্ধবিরতি গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক মানবিক সহায়তা নিয়ে যাওয়াসহ বিপর্যস্ত অঞ্চলগুলোতে আরও মানবিক সহযোগিতা পৌঁছানোর অনুমতি দেবে।
এই চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে পুরুষ সৈন্যসহ সব জীবিত জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা হবে। এই যুদ্ধবিরতি তখন স্থায়ীভাবে দীর্ঘ শত্রুতার অবসান ঘটাবে।
এই চুক্তির প্রথম ও দ্বিতীয় দফার মধ্যে সমঝোতা কঠিন হতে পারে স্বীকার করেছেন বাইডেন।
এই প্রস্তাবে রাজি হতে হামাসকে আরও আহবান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তিনি তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে বলেছেন, ‘এই চুক্তি অবশ্যই মেনে নিতে হবে, যাতে আমরা লড়াই বন্ধ দেখতে পারি।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এক্সে (সাবেক টুইটার) এই চুক্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, সারা বিশ্ব গাজায় অনেক দুর্ভোগ এবং ধ্বংস প্রত্যক্ষ করছে। এখন এটি থেকে যাওয়ার সময়। আমি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যে শেষ পর্যন্ত একটি টেকসই শান্তির জন্য এই সুযোগটি কাজে লাগাতে সব পক্ষকে উৎসাহিত করি।
কয়েকদিন আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে যুদ্ধ বন্ধে রাজি নন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন নতুন করে যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই প্রস্তাবনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
আগে যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও সেগুলো খুব একটা কাজে দেয়নি। বর্তমানের যুদ্ধবিরতির জন্য এই চুক্তি হামাসকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনার জন্য করা হচ্ছে। এরইমধ্যে হামাস এই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হামাসের অন্যতম দাবি।
এই চুক্তির তৃতীয় দফায় হয়তো দেখা যাবে, কোনো মৃত ইসরায়েলি জিম্মিদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বাড়িঘর, স্কুল ও হাসপাতাল পুনর্নির্মাণের জন্য মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে পূর্ণগঠন পরিকল্পনা।
বাইডেন তার বক্তব্যে স্বীকার করেছেন যে, হয়তো কিছু ইসরায়েলি এবং ইসরায়েল সরকারের কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘যতই চাপ আসুক আমি ইসরায়েলের নেতৃত্বকে এই চুক্তির পক্ষে থাকার আহবান জানাচ্ছি।’
ইসরায়েলি নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা এই মুহূর্তটিকে হারাতে পারি না।
বাইডেন বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলার সময় হামাস যেরকম শক্তি নিয়ে হামলা চালিয়েছিলে, সে রকম শক্তি বা ওরকম হামলা চালানোর মতো সেই সামর্থ্য এখন আর তাদের নেই। এটিকে যুদ্ধ বন্ধের একটি সংকেত হিসেবেই দেখছে ওয়াশিংটন।
এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছিলেন, সব জিম্মিদের মুক্তি ও হামাসের সামরিক ও শাসন ক্ষমতা নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না।
হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার, পুনর্গঠন এবং বন্দি বিনিময়ের আহবানের কারণেই এই প্রস্তাবটিকে ‘ইতিবাচকভাবে’ দেখছে।
হামাস এটিও বলেছে যে, তারা স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতিকে কেন্দ্র করে যেকোনো প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখে। তবে শর্ত একটিই, সেটি হলো ইসরায়েল যেন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
এই আলোচনার সঙ্গে যুক্ত আরেক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা যিনি ইসরায়েলের নতুন প্রস্তাবটিকে দেখছেন। তিনি বলেন, নথিতে এমন গ্যারান্টি নেই যে যুদ্ধ শেষে গাজা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে।
এই প্রস্তাবটি কাতারভিত্তিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হামাসের কাছে পাঠানো হয়েছে।
গাজায় ক্রমবর্ধমান বেসামরিক মানুষের হতাহতের পর ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন নিয়ে সারা বিশ্বে কঠোর সমালোচনা হয়। এরপরই সমালোচনার মুখে যুদ্ধ বন্ধে দুই পক্ষকেই আলোচনার আহবান জানিয়ে আসছিল প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে হোয়াইট হাউজ বলেছে যে তারা বিশ্বাস করে না যে রাফায় ইসরায়েলি অভিযান রেডলাইন ক্রস করতে পারে এবং মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।
এমন সমালোচনার মুখে গত রোববার রাফা শহরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৪৫ জন ফিলিস্তিনি মারা যাওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন বিবৃতি এসেছে।
শুক্রবার আলাদা এক বিবৃতিতে মার্কিন আইনপ্রণেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে নেতানিয়াহুকে ওয়াশিনটনের কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তবে তা কখন বা কোথায় হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। এরপর হামাস নির্মূলের কথা জানিয়ে ফিলিস্তিনের গাজায় বোমা হামলা করে আসছে ইসরায়েল।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ৩৬০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছে।