মানবপাচার চক্রের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোর। এই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হওয়া নড়াইলের দুই যুবকের সন্ধান করতে গিয়ে পিবিআই ওই চক্রের সন্ধান পায়। এরপর এই চক্রের অন্যতম হোতা রকিবুল ইসলাম ফরাজিসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২৬ বছর ধরে প্রবাসে থাকা রকিবুল সর্বশেষ লিবিয়ায় অবস্থানকালে ওই মানবপাচার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই চক্রের দুই সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক মাসেই লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই টাকার পুরোটাই বিদেশে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের অর্থ।
পিবিআই যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন জানান, শনিবার (১০ ডিসেম্বর) একটি মানবপাচার মামলায় অভিযুক্ত নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল গফুর ফরাজীর ছেলে রকিবুল ইসলাম ফরাজি (৫৭), যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধুলগ্রামের আরশাদ আলীর স্ত্রী হাফিজা বেগম (৫৫) এবং হাফিজা বেগমের দুই মেয়ে শিরিনা আক্তার (৩৫) ও সুমনা আক্তারকে (২৯) গ্রেফতার করেছে পিবিআই।
এদিকে, মানবপাচারের ওই মামলার সূত্র ধরে পিবিআই লিবিয়ায় মানবপাচার চক্রের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে। এই চক্রের অন্যতম হোতা রকিবুল ইসলাম ফরাজি। তিনি ২৬ বছর ধরে প্রবাসে ছিলেন। রকিবুল সর্বশেষ লিবিয়ায় অবস্থানকালে ওই মানবপাচার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশে জিম্মি ও পাচার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
পিবিআই জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চন্দ্রপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম মৃধার ছেলে নাইম মৃধা (২৫) ও রবিউল ইসলামের ভাগনে জহিরুল ইসলাম (২৫) বৈধভাবে লিবিয়ায় যান। তারা লিবিয়ায় যাওয়ার পর রবিউলকে জানান, কালিয়ার সাতবাড়িয়া গ্রামের এক ব্যক্তি তাদেরকে বেশি বেতনে লিবিয়া থেকে ইতালিতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। সেখানে গেলে তাদের বেতন হবে মাসিক প্রায় এক লাখ টাকা।
রবিউল মৃধাকেও ওই ব্যক্তি ফোন করে তার ছেলে নাইম মৃধা এবং ভাগনে জহিরুল ইসলামকে নিরাপদে ইতালিতে পাঠিয়ে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। অপরিচিত হওয়ায় রবিউল তাদের ইতালিতে পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করেন। এর ৫/৬ দিন পর লিবিয়া থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে রবিউলকে মোবাইলফোনে জানান, তার ছেলে ও ভাগনেকে অপহরণ করা হয়েছে এবং তাদের মুক্তিপণ দাবি করেন। তারা রবিউল ইসলামকে বলেন, আপনার ছেলে এবং ভাগনেকে বাচাঁতে হলে আমাদের দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর এবং ব্যাংকের হিসাব নম্বরে টাকা পাঠাতে হবে। অন্যথায় তাদের খুন করে ফেলা হবে।
পরবর্তীকালে রবিউল বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠান। তারপর থেকে রবিউল ইসলাম মৃধার ছেলে এবং ভাগনের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রবিউল বাদী হয়ে নড়াইল মানবপাচার প্রতিরোধ দমন ট্রাইব্যুনালে গত ২২ মে মামলা করেন। আদালতের আদেশে যশোর পিবিআই পুলিশ সুপার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে এসআই হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ওই অপরাধীদের শনাক্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেন। পরবর্তীকালে রবিউল ইসলাম মৃধা ওই চারজন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে কালিয়া থানার গত ৯ ডিসেম্বর মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই যশোরের এসআই হাবিবুর রহমান জানান, মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। মূল অভিযুক্ত নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের রকিবুল ইসলাম ফরাজি প্রায় ২৬ বছর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেছেন। সর্বশেষ তিনি লিবিয়াতে ছিলেন। লিবিয়ায় ওই দুজনকে অপহরণের সময়ও তিনি সেখানেই ছিলেন। এরপর গত ঈদুল আজহার আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
তিনি জানান, রবিউল ইসলামেরর ছেলে নাইম মৃধা ও ভাগনে জহিরুল ইসলাম অপহরণের পর যে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে তার সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করেন। তদন্তে দেখা যায়, আসামি হাফিজা ও শিরিনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে। তাদের দুই অ্যাকাউন্টে শুধু গত মার্চ মাসেই প্রায় ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে হাফিজার অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ২৪ লাখ এবং শিরিনার অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা।
এসআই হাবিবুর বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজা ও শিরিনা স্বীকার করেছেন, ওই টাকা রকিবুল ইসলাম ফরাজির। তাদের অ্যাকাউন্টে আসা টাকা তারা রকিবুলের অ্যাকাউন্টে দিয়ে দিয়েছেন। শনিবার অভিযুক্ত চারজনকে নড়াইল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হলে অভিযুক্তরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, লিবিয়ার মানবপাচার চক্রের মাস্টারমাইন্ড এই রকিবুল। তাই তিনি কাদের মাধ্যমে এই জিম্মি করা, মুক্তিপণ আদায় করা ইত্যাদি কীভাবে করেছেন তার তদন্ত করা হচ্ছে। এজন্য তার সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে।