ঢাকার মিরপুরের আলীনগর এলাকায় জমি দখল ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব ও সাবেক এমপি এম এ আউয়াল। জমি দখলসহ অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করেছিলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তার বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যেতো। তার অফিসে টর্চার সেলে করা হতো নির্যাতন। অনেকেই তার অত্যাচারে প্রাণ বাঁচাতে নিজস্ব বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। যারা যাননি তারা হামলা ও মামলার শিকার হয়ে কেউ আছেন পালিয়ে, কেউ আছেন জেলখানায়। তার অপকর্মে মদত যোগাতেন স্থানীয় দুইজন কাউন্সিলর। বিনিময়ে পেতেন কাড়ি কাড়ি অর্থ।
এদিকে, গতকাল সাহিনুদ্দীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আসামি সুমন ১৬৪ ধারাই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ১৬ই মে পল্লবীতে শিশু সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দীন নামে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই খুনের ঘটনায় গত বুধবার গভীর রাতে র্যাব নরসিংদীর ভৈরবে অভিযান চালিয়ে সাবেক এমপি আউয়ালকে এবং এর আগের রাতে চাঁদপুরের হাইমচর থেকে নূর মোহাম্মাদ হাসান ও পটুয়াখালীর বাউফল থেকে জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবুকে গ্রেপ্তার করে। সুমন ব্যাপারীসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকার ডিবি পুলিশ। এ নিয়ে ওই হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনার দুইজন আসামি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
এ বিষয়ে মামলার মুখ্য সমন্বয়কারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর জোনের ডিসি শ্রী মানস কুমার পোদ্দার গতকাল মানবজমিনকে জানান, ‘মামলা তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। মামলার অন্যতম আসামি আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। ওই এলাকায় অপরাধের সাম্রাজ্য ভেঙে দেয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।’ নাম প্রকাশে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, এ খুনের মূল পরিকল্পনাকারী এম এ আউয়াল এবং তার প্রধান সহযোগী সুমন ব্যাপারী, হাসান ও জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবু রিমান্ডে আছে। সুমন ব্যাপারী সন্ত্রাসী ভাড়া করে এবং খুনের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল। সুমন সাহিনুদ্দীনকে খুনের জন্য শরিফকে ভাড়া করেছিলো। আউয়ালের দুই সহযোগী মুরাদ হোসেন ও রকি তালুকদার গত শনিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
গতকাল আলীনগরের বুড়িরটেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকায় এখনো পরিস্থিতি ভালো আছে। আলী নগরের একদিকে পল্লবীর মিরপুর সিরামিকস, অন্যদিকে মিরপুর ডিওএইচএস। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মাণাধীন আবাসন প্রকল্প ন্যাশনাল হাউজিং রয়েছে অন্যপাশে। মিরপুর সিরামিকসের ভেতর দিয়ে আলী নগরে যেতে হয়। রাতের বেলা সিরামিকসের ফটকগুলো বন্ধ হলে একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন এখানকার বাসিন্দারা। গতকাল ওই এলাকায় গেলে সবার মুখে সাবেক এমপি আউয়ালের কথা শোনা যায়। আউয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার গ্যাং বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। এ ছাড়াও তাকে যে দুইজন কাউন্সিলর মদত দেয় তারাও গা-ঢাকা দিয়েছেন।
সরজমিন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ওই এলাকায় অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক এমপি এম এ আউয়াল এবং দুইজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ২০১৪ সালে মহাজোটের কোটায় ‘বাইচান্স’ এমপি হয়েছিলেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। এর আগে দেশের একজন প্রভাবশালী হাসপাতাল ব্যবসায়ীর তদবিরে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব হন তিনি। তবে এমপি বনে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যবসায়ীকে এড়িয়ে চলতেন আউয়াল। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তরিকত ফেডারেশন তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিলে তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি দলটির চেয়ারম্যান। তবে ২০১৮ সালে তিনি মহাজোটের মনোনয়ন না পাওয়ায় আর এমপি হতে পারেননি।
সূত্র জানায়, সাহিনুদ্দীন খুন হওয়ার মাত্র ৯ দিন আগে আউয়াল তার বিরুদ্ধেই ৫০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি এবং হত্যাচেষ্টার মামলা ঠুকে দেন। গত ৭ই মে পল্লবী থানায় এ মামলা (নম্বর-১৯) করেন আউয়ালের পক্ষে তার আবাসন প্রকল্প হ্যাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সিকিউরিটি সুপারভাইজার মো. মোকসেদ আলী। পল্লবীর বাউনিয়া মৌজায় ঢাকা জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণকৃত ১৬৮ একর জমির একটি অংশে জবরদখল করে গড়ে তোলা আবাসন প্রকল্প হ্যাভেলি প্রপার্টিজ নামের প্রতিষ্ঠানটি আউয়ালের মালিকানাধীন। এ প্রকল্পে বিভক্ত দুই গ্রুপের মধ্যে একটির নেতৃত্ব দেন কিবরিয়া, অন্যটির আবু তাহের।
জমি দখল ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আউয়াল ওই এলাকায় নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করেছিলেন। বাহিনীর সদস্যরা হলেন, মনির, মানিক (সম্প্রতি ক্রসফায়ারে নিহত), ডেবরা বাবু, বাবুয়া সুমন, দিপু, রাজন, আলাল, জনি, কনিক, রিকশা সুমন, সরোয়ার সরো, মোল্লা বস্তির ছোট্ট গিটু বাবু, নাটা শামীম, ইব্রাহীম, বকর, সেলিম, সাদ্দাম, পনির, আনোয়ার, জাসিম, শহীদ রুবেল, কসাই জাবেদ, গ্যাং বাবু, পাপপা, ইয়াবা শফিকুল, সাগর, ইকবাল, আচার সুমন, কালা ছোট্ট বাবু, তবলা সুমন, শাহীন, ইয়াবা বাবু, পাংকু জামিল, টিটু, প্রদীপ খোকা, সুকান্ত রায়, মুসা, কানা রনি, কানা জুয়েল, দাঁতভাঙা বুলু, আবু সালেহ, দাগি ফিরোজ, কিলার বাপ্পী, হকি সুমন, নাসির, কাজল, আলু রুবেল, নাটা বাবু, হাসান ও মাহবুব রনি। এদের নামে পল্লবী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এসব গ্যাং সদস্যদের এলাকাতেই আউয়াল শেল্টার দিতেন। আউয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে।