বাবা প্রায়ই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাতেন মায়ের ওপর। এভাবে সংসারে অশান্তি লেগেই ছিল বহুদিন ধরে। এতে ছেলেরা অতিষ্ট হয়ে পারিবারিক অশান্তি থেকে মাকে মুক্তি দিতে ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নেন। তিন সন্তান মিলে পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন বাবাকে। পরে ডাকাতের হাতে বাবা হত্যার নাটক সাজান তিন ছেলে।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের ভাসানচর এলাকার স্থানীয় কাঠমিস্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম হাওলাদারের (৪৫) চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৭ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ।
এর আগে গতকাল (১০ এপ্রিল) ভোরে মেঘনা নদীতে মাছ ধরার সময় ডাকাতের হামলায় নুর ইসলাম নিহত হয়েছে বলে ছেলেরা দাবি করে বক্তব্যে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের কাছে।
পুলিশ জানায়, মূলত মা তাছলিমা বেগমকে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে তিন ছেলে মিলে বাবা নুরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তারপর ঘটনা ধামাচাপা দিতে সাজানো হয়েছিল ডাকাত হামলার নাটক।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) দুপুর ৩টায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেসব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন।
পুলিশ সুপার বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাঠমিস্ত্রি নুরুল ইসলামের পরিবারে চলছিল দাম্পত্য কলহ।
রোববার (৯ এপ্রিল) সকালে দাম্পত্য কলহের জের ধরে নিহত নুরুল ইসলাম তার স্ত্রী তাছলিমা বেগমকে পারিবারিক কথা কাটাকাটির জেরে মারধর করে। এতে অসুস্থ অবস্থায় নিহতের স্ত্রী তাছলিমা চলে যায় মেয়ের বাড়িতে। এরপর নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় নুরুল ইসলাম। পরে একই দিন বিকেলে নিহতের বোন হামিদা বেগমের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি।
এদিকে, প্রতিনিয়ত মাকে মারধর করায় বড় ছেলে সুমন হাওলাদার (৩০), মোহাম্মদ আলী হাওলাদার (২৩) ও রাসেল হাওলাদার (২০) ক্ষিপ্ত হয়ে পরিকল্পনা করে বাবা নুর ইসলামকে প্রাণে মেরে ফেলার। তারা ভাবেন বাবা নুরুল ইসলাম না থাকলে সমাধান হবে সব সমস্যার।
এরপর পরিকল্পিতভাবে গতকাল সোমবার ভোরেরাতে ছেলে মোহাম্মদ আলী ও রাসেল হালদার দুজন মিলে ডেকে আনে আরেক ভাই সুমন হাওলাদারকে।
পরে ঘুমন্ত অবস্থায় নুরুল ইসলামকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও শক্ত কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে তিন ভাইসহ অজ্ঞাত আরও ২ থেকে ৩ জন মিলে।
এসময় নিহত নুর ইসলাম সন্তানদের কাছে বাঁচার আকুতি জানালে, পরে শক্ত করে দুইহাত চেপে ধরেন দুই ভাই। আরেক ভাই কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে বাবার।
পরে সকালে নিহত নুরুল ইসলাম হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে, তিন সন্তান মিলে অচেতন অবস্থায় তাকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে পরে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
এরপর পুলিশের কাছে সন্তানরা জানান, রাতে মাছ ধরার ট্রলারে হামলা চালায় সঙ্ঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্যরা। এসময় বাধা দেওয়ায় হত্যা করা হয় নিহত নুর ইসলামকে।
তবে এমন সাজানো ঘটনা বিশ্বাস জোগাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ফলে জোরালো তদন্ত শুরু করে পুলিশ।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ডাকাতদের হামলায় নিহত হওয়ার কথা প্রচার চালালেও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে ভিন্ন তথ্য আসে পুলিশের কাছে।
এতে সোমবার দুপুরে পুলিশ নিহতের ২ ছেলে সুমন হাওলাদার ও তার স্ত্রীসহ আরেক ভাই মোহাম্মদ আলী হাওলাদারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। পরে পুলিশি জিজ্ঞেসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সন্তানেরা।
তবে এই ঘটনায় নিহতের আরেক ছেলে রাসেল হাওলাদার এখনও পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
এদিকে সোমবার রাতে নিহতের ৩ ছেলেসহ অজ্ঞাত ২ জনকে আসামি করে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে নিহতের বোন হামিদা খাতুন (৪০)।
এরপর মঙ্গলবার বিকালে জবানবন্দী রেখে গ্রেফতার ব্যক্তিদের মুন্সিগঞ্জ আদালতে পাঠানো হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে জানায় পুলিশ সুপার।
নিহত মো. নুর ইসলাম সদর উপজেলার আঁধারা ইউনিয়নের ভাসান চর এলাকার স্থানীয় মৃত সুবুদ হালদারের ছেলে।