আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নভোচারীদের একেক দফায় কাটাতে হয় বেশ কিছু দিন। কেমন যায় তাদের দিনকাল? মহাকাশ ভ্রমণ কি তাদের কাছে খুব রোমাঞ্চকর কিছু? জানা গেলো- রোমাঞ্চ তো দূরে থাক, পারলে পৃথিবীতে পালিয়ে বাঁচেন তারা। কারণ আছে ঢের।
প্রশিক্ষণেই অর্ধভোজন
মোশন সিকনেস
স্পেস স্টেশনে নভোচারীদের প্রায়ই বমি করতে হয়। কারণ মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় তাদের উপর-নিচ বলতে কিছু থাকে না। ভারসাম্য ঠিক করতেই যেন ঘাম ছুটে যায় তাদের। কোনটা উপর কোনটা নিচ, এসব নিয়ে চোখ যখন দ্বিধায় পড়ে যায় তখন বমি আসবেই। আর এ জন্য স্পেস স্টেশনে নভোচারীদের জন্য থাকে বমি করার বিশেষ ব্যাগ। ওই ব্যাগটাও আবার ফেলে দেওয়ার জো নেই। রেখে দিতে হয় আশপাশের কোনও বাক্সে।
পায়ের তালু নিয়েও সমস্যা
আমাদের পায়ের তালু বেশ শক্ত। কারণ ওটাকে শরীরের সমস্ত ওজন নিতে হয়। কিন্তু ওজনহীন পরিবেশে এ কাজটা করতে হয় না। যে কারণে স্পেসে বেশি সময় কাটালে নভোচারীদের পায়ের তালু হয়ে যেতে থাকে পাতলা। চামড়া খসে একেবারে নবজাতকের ত্বকের মতো হয়ে যায় তালু। বার বার মোজা খুলে সেই খসে পড়া চামড়া ফেলে দেওয়াটাও একটা বড় যন্ত্রণা।আইসোলেশন
আইসোলেশনে থাকা যে কী বস্তু সেটা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে গেলো দেড় বছর। তবু তো মানুষ মানুষের সঙ্গে দেখা করেছে, ভিডিও কলে কথা বলেছে, বাজারেও গেছে। কিন্তু নভোচারীদের সেই সুযোগ কই! কঠিন আইসোলেশনে থাকতে থাকতে নভোচারীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও হয়তো বুঝতে দেন না। আর তারা যাতে মানসিকভাবে অসুস্থ না হয়ে যান, এজন্য ধরিয়ে দেওয়া হয় একগাদা কাজ।
ঘুম নেই
দিনের পর দিন পরিবার ছেড়ে একা কিংবা বদ্ধ পরিবেশে অল্প কয়েকজন মিলে থাকার যন্ত্রণা পোহাতে হয় নভোচারীদের। এ কারণে বিষণ্নতার চোটে আসতে চায় না ঘুম। তারওপর প্রায়ই চোখের ওপর জুড়ে বসে মহাজাগতিক নানা রশ্মি। শরীরের জৈবিক ঘড়িটাও হয়ে যায় অচল। দিন-রাত বলে কিছু নেই আইএসএস-এ। ২৪ ঘণ্টায় ১৬ বার সূর্য ওঠে আর ডোবে। আবার বিছানার সঙ্গে নিজেকে বেঁধেও রাখতে হয়। তা না হলে ঘুমাতে গিয়ে দেখা যাবে শরীরটা শূন্যে ভেসে আরেক বিপদ ঘটাচ্ছে। এভাবে ঘুমানো যায়?বধির হওয়ার আশঙ্কা
স্পেস স্টেশনের যন্ত্রপাতির শব্দ লেগেই থাকে। পুরো স্টেশন নিশ্ছিদ্র। কোনও শব্দ বের হয় না। আর বাইরেও এতটা নীরব-নিথর যে ভেতরের পিন পড়ার শব্দটাও কানে আসে। এদিকে অনবরত কানের কাছে যান্ত্রিক গুঞ্জন বাজতেই থাকে। আমেরিকার সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল জানিয়েছে টানা ৭০ ডেসিবলের বেশি শব্দ শুনতে থাকলে বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণেই ২০০৬ সালে পৃথিবীতে আসার পর দেখা গেলো নাসার নভোচারী বিল ম্যাকআর্থার ও রুশ নভোচারী ভ্যালেরি তোকারেভের শ্রবণশক্তি একেবারে কমে গিয়েছিল।
মহাকাশেও গ্যাস্ট্রিক
গ্র্যাভিটি নেই তো ঢেঁকুরও বন্ধ। খাওয়ার পর ঢেঁকুর তুলতে না পারায় নভোচারীদের পেটটা ফুলে ওঠে ঢোলের মতো। আর সেই অস্বস্তিকর অনুভূতিটা নিয়েই তাদের কাটাতে হয় দীর্ঘ সময়।
উচ্চতা নিয়ে ঘাপলা
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিটা আমাদের উচ্চতাকে একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় আটকে রাখে। মহাকাশেই গেলেই গা-ছাড়া ভাব দেখায় মেরুদণ্ডটা। কয়েক ঘণ্টা না যেতেই নভোচারীরা খানিকটা লম্বা হয়ে যান। এতেও বেশ কষ্ট পোহাতে হয় তাদের। আবার পৃথিবীতে পা রাখা মাত্রই নভোচারীরা দ্রুত আগের উচ্চতায় ফিরে আসেন। তখনও দেখা দেয় যন্ত্রণা। পুরোটা সময় নভোচারীদের পোহাতে হয় ব্যাক পেইন।
সবচেয়ে বড় সমস্যা
বাকি সব সমস্যা এর কাছে নস্যি। এমনটাই জানা গিয়েছিল দীর্ঘসময় স্পেস স্টেশনে থাকা পেগি হুইটসনের ভাষ্যে। সমস্যাটা হলো প্রাকৃতিক কর্ম। বাকি সমস্যাগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। মাধ্যাকর্ষণ না থাকাটাই যত নষ্টের গোড়া। তাই এ কাজে ব্যবহার করতে হয় ভ্যাকুম ক্লিনারের মতো বিশেষ একটি টিউব। প্রস্রাবে বিশেষ সমস্যা না হলেও মলত্যাগ মানেই একটা বিভীষিকা। পেগি জানিয়েছিলেন, ব্যাপারটা সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মহাকাশে তো সুয়ারেজ লাইন নেই। সুতরাং ‘সব’ প্যাকেটবন্দি করে রাখতেই হবে। এ কাজটা করতে হয় নিজেকেই। কোনোভাবে যদি ‘কিছু অংশ’ ছুটে বেরিয়ে যায় তবে লঙ্কাকাণ্ড শুরু। হাতে গ্লাভস পরে ওই ছুটে যাওয়া অংশটাকে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে বাকিরাও। কারণ উড়ে উড়ে সেটা কোন ফাঁকে গিয়ে লুকাবে কে জানে!