(২য় পর্ব)
আমাদেরকে, প্রায় ৫০ জন, একটা ১৫x১৫ ফুট রুমের ভিতর ঠুকিয়ে, দার করিয়ে রাখা হলো। সারা দিনের ধকল, ভয়, উত্কণ্ঠা সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা খুবেই সংকটময়। সারাদিন মাঠের মধ্যে, রোদে পুরে সবার অবস্থা খুবেই সংগিন। এমন সময় একজন, ওয়াশরুমে যেতে চাইলো। স্যারেরা খুবেই বিরক্ত হলেন। মনে হলো জীবনে প্রথম শুনলো, এ কথা। আদেশ হলো, একটা কাঠের প্যান নিয়ে আসার। সেটা সবার মাঝে রাখা হলো, এবং বলা হলো, এটাতেই সবার মাঝে, প্রাকৃতিক কার্য সম্পাদনের জন্য। কি নির্লজ্জ কায়দা ! কিছু করার মত অবস্হা আমাদের কারোরই ছিলো না। আমাদের অনেকেই বাধ্য হল এরি মধ্যে কাজ সারতে।
আমরা যারা এখানে আছি, তারা বিভিন্ন ভাবে ওদের হাতে পরেছি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ভয়ে, রাতে যারা বিভিন্ন শিক্ষকদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং ওদের কাছে থাকা লিস্ট, সে ভাবে ভাগ করা শুরু হলো। তার পর আলাদা করা হলো আমাদের ১১ জন( সম্ভবতঃ) , যারা জাকসু ও হলের নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছিলো ও আমি। এর পর সামরিক জান্তা, সি এম এল এ এর মত একটা উপদেশ মুলক ভাষন দেয়ার পর, ১১ জন বাদে অন্যদেরকে ছেড়ে দেয়ার ঘোষনা এলো ! আমাদের মাঝে এক মিশ্র অনুভুতির সৃষ্টি হলো ! আনন্দ -বেদনার সে এক রুপ ! পাক- বাহিনীর নৃশংসতার কথা মনে এলো, গা-হীম করা এক অনুভুতি। যারা যাচ্ছে তারা, আর আমরা যারা থাকছি, সবাই এক অনিশ্চয়তার মাঝে পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার বন্ধু, আলিমুজ্জামান মুকুল বললো, টাকা পয়সা আছে ? বললাম, আছে, অল্প ! ও, ওর কাছে থাকা, অনেকগুলো খুচরা পয়সা আমাকে দিলো। মাসের মাঝামাঝি সময়, আমাদের কাছে থাকা টাকা তখন শেষের দিকে। মাসের প্রথমেই আমরা হলের খাবারের কুপন কিনে রাখতাম। মুদি দোকানে, টাকা দিয়ে রাখতাম, যাতে করে সারা মাস খরচ নেয়া যায়। তাই মাসের মাঝামাঝি টাকা শেষের দিকে চলে আসে। আর আমার অবস্থা, আরো খারাপ থাকতো। রাজনীতি করতাম। মুকুল পুরোটা যানে। তাই জিগ্যেস করে টাকা দিলো। আমি ব্যাগে ভরে রাখলাম। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম ! ওর চোখ’টা ছলছল করছিলো। চলে যাচ্ছে আর আমার ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় ভরা !
ওরা চলে যাচ্ছে ! বাসায় পৌঁছোবে তো ! আমাদেরকে কোয়ার্টার গার্ড রুমে রেখে, বাকিদের নিয়ে চলে গেলো। কোথায়, তা আমরা জানতেও পারলাম না। ছেড়ে দেবে, বললো। বাহিনী গুলোর ছেড়ে দেয়া যে, কোন ছেড়ে দেয়া, তা বোঝা দুস্কর। বাড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয়া, নাকি মৃত্যুর কাছে ছেড়ে দেয়া, এ নিয়ে আমরা সত্যিই হতবিহ্বল !? বুঝতে পারছিলাম না।
রাত তখন গভীর ! বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোথাও শেয়াল ডেকে উঠলো ! মধ্য ফেব্রুয়ারীর শীত। তারপরেও ভয়ে গা ঘেমে উঠছে ! গা শির শির করছে। কি হবে, জানিনা !
ওয়াজেদ বললো,” বন্ধু, কি আর করা, চলে লম্বা হয়ে শুয়ে পরি !”
মেঝে তে, সার্টপ্যান্ট পরেই পাশাপাশি শুয়ে পরলাম ।
পুরো ঘর দুর্গন্ধে ভরা।
লেখক : সদরুল আলম হারুন (কলামিস্ট)
চলবে–