(৩য় পর্ব)
১৭ ফেব্রুয়ারী
মধ্য ফেব্রুয়ারীর শীত। ভয়ে গা ছম্ ছম্ করছে। কি হবে, কিচ্ছু জানিনা।
ওদের নিয়ে চলে গেলো। চারিদিক কেমন যেন গা হিম করা নিস্তব্ধতায় ভরা।
তখনই বন্ধু ওয়াজেদ বলে উঠলো, “চল, লম্বা হয়ে শুয়ে পরি “।
সবাই যেন এ রকম কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সংগে থাকা ব্যাগ থেকে সবাই কাপড় বের করে, শোয়ার বন্দোবস্ত করছিলাম। মধ্য ফেব্রুয়ারীর কনকনে শীত, একটা টিনের দো’চালা ঘরের হিমশীতল সিমেন্টের মেঝেতে শুতে হবে। কোন বিছানা, চাদর, কম্বল কিচ্ছু নাই। তাই সবাই প্যান্ট, সার্ট, সোয়েটার যা কিছু ছিলো তাই পরে, শুয়ে পরলাম ! আমরা শুয়ে আছি, পাশাপাশি ১১ জন। ১১ টা যুবক। ১১ টা স্বতন্ত্র, স্বাধীন লড়াইয়ের সৈনিক।
কে যেন ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ! সবাই চুপ করে তার কান্নার সাথে, ভেতর ভেতর নিজেরাও নিশ্বব্দে কাদতে থাকে। ঠান্ডা বাতাস আরে ভারি হয়ে উঠলো !
আমাদের নিয়ে মিলিটারিদের প্লান’টা কি বুঝতে পারছি না। তবে, আমাদের উপর ওদের যে প্রচন্ড রাগ, এটা বুঝতে পারছিলাম। দেশের মাটিতে, ক্যান্টনমেন্টের পাশে দাড়িয়ে ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করাটা ওরা খুব খারাপ ভাবেই নিয়েছে। প্রায় সরাসরি গুলি করে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে, সকল শক্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর ঝাপিয়ে পরে, আমাদের ধরে এনেছে। আমাদের উপর প্রতিশোধ নেবেই। তবে কি প্রক্রিয়ায় ও কতটা নেবে, তা আন্দাজ করতেও পারছি না। সারা দেশের ছাত্র সমাজ কি এদের রুখে দিতে পারবে !
সকালে দরজায় তালা খোলার শব্দে, উঠে বসলাম। দু’জন অফিসার ঘরে ঢুকেই, জেনারেল আইউব খানের ইস্টাইলে বললেন ” Good morning “! সে কি দরাজ কন্ঠস্বর ! কি ইংরেজি উচ্চারণ ! আহা! আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিচ্ছু শিখতে পারলাম কই ! আমরাও মিনমিনে গলায় উত্তর দিলাম। চেয়ে দেখি সাদা প্যান্ট, সাদা গেন্জি ও সাদা কেডস পরা, মুখে বিদ্রুপের হাসি মাখা। তো, শালা’রা রাজনীতি করবি না? বাইনচোত! অকথ্য, শ্রবন অনুপযোগী কত না সু- মিষ্ট বানী! সাথে দু-পায়ের কেরামতিতে আমরা ক্ষতবিক্ষত! ওদের মুখে পৈশাচিক হাসি! কি আনন্দ ! বুটের তলায় জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা কাতরাচ্ছে ! আহ্ কি আনন্দ। আমরা পিছুতে পিছুতে দেয়ালের সাথে লেপটে গেলাম ! কি অসহ্য যন্ত্রণা, দেহ ও মনে !
আমরা সবাই এখানে রাজনীতি করা মানুষ। আমরা সবাই একটা নির্দিষ্ট কারনে, মজিদ খানের শিক্ষা নীতি বিরোধী আন্দোলন করা ছাত্র। আমরা কোন Miscreants না। এটা রাষ্ট্রের বোঝা উচিৎ। নিদেন পক্ষে এ কর্মকর্তাদের তো এ বোধটুকু থাকার আকাংখা আমরা করতেই পারি। নয় কি ? নাকি স্বাধীন দেশের এঁরাও পরাধীন দেশের বাহীনিগুলোর সংস্কৃতিই বহন করছে? এ জন্যই একটা প্রচন্ড ঝাকুনি দরকার, দরকার জনগনের সরকার। যারা এ বাহিনী গুলোকে বোঝাতে সামর্থ হবে, দেশের জনগনের সাথে সত্যিকার মানুষের মত ব্যবহার করতে হবে।
ওনারা সকালে এক্সারসাইজ করতে এসেছিলেন। যাওয়ার সময় আমাদেরকে দেখে গেলেন, কিছুটা দেখিয়েও গেলেন বৈকি !
(চলবে)
লেখক :
সদরুল আলম হারুন (কলামিস্ট)