ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৯এ ও ৮৯সি ধারা এবং অর্থ ঋণ আদালতের ২২ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনে থাকা মধ্যস্থতা সংক্রান্ত বিধি-বিধান পালনে নির্দেশিকা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের জুডিসিয়াল রিফর্মস কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশক্রমে আবশ্যিকভাবে মধ্যস্থতার সংশ্লিষ্ট বিধানাবলি পালনে এ নির্দেশিকা জারি করা হয়।
বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
মধ্যস্থতা শুরু হলে তার মাধ্যমেই মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। আর মধ্যস্থতার আলোচনা শুরুর পর যদি দেখা যায় বিরোধীয় বিষয়টিতে পক্ষসমূহের অবস্থান এমন অনমনীয় যে, কোনো মধ্যস্থতা সম্ভব নয়, অথবা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি কোনো পক্ষের জন্যই অনুকূল কোনো অবস্থানের সৃষ্টি করছে না, তাহলে সেই পর্যায় হতে পুনরায় প্রচলিত আইনে মোকদ্দমার কার্যক্রম চালু করা সম্ভব। কিন্তু মধ্যস্থতার আলোচনা একবার শুরু হলে অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষগণ আর প্রথাগত মামলা পরিচালনার কার্যক্রমে না গিয়ে মধ্যস্থকারীর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী হবেন। এমতাবস্থায় পক্ষগণের অন্তত একবার মধ্যস্থতার জন্য আলোচনায় বসা উচিত।
মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে পক্ষগণ নিজেরাই নিজেদের পক্ষের মধ্যস্থতাকারী নির্বাচন করতে পারবেন। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় পুরো বিষয়টিতেই পক্ষগণের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। পক্ষগণ আদালত বা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে মোকদ্দমার বিরোধীয় বিষয় মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে চাইলে এ বাবদ তাদের কোনো খরচ বহন করতে হয় না।
অন্যক্ষেত্রে দরিদ্র ও অস্বচ্ছল পক্ষগণ প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণসাপেক্ষে মধ্যস্থতা বাবদ খরচ আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নিকট হতেও লাভ করতে পারে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতাকারী কোনও সিদ্ধান্ত প্রদান করেন না, বরং তিনি পক্ষগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেন। এক্ষেত্রে পক্ষগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা থাকে।
সুবিধাগুলো হলো—
মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা বজায় থাকা: মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় যে কোনো পর্যায়ে পক্ষগণের মধ্যে যে আলোচনাই হোক না কেন বা যে দলিল-প্রমাণই উপস্থাপন করা হোক না কেন, তার গোপনীয়তা অটুট থাকে এবং মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতার আলোচনা আদালতে প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য হয় না।
মধ্যস্থতার প্রক্রিয়া সহজ ও ফলপ্রসূ: মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে পক্ষগণ বা তাদের নিযুক্ত আইনজীবীগণ মধ্যস্থতা আলোচনার স্থান, কাল এবং কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়া নিজেরাই ঠিক করেন বলে এর কার্যপ্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ ও ফলপ্রসূ। এর ফলে পক্ষগণের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হয়।
মধ্যস্থতার প্রক্রিয়াটি অনানুষ্ঠানিক: আদালতে অথবা সালিস আইনের অধীনে সালিসে সাধারণত পক্ষগণের কথা বলার সুযোগ কম থাকে। কিন্তু মধ্যস্থতার প্রক্রিয়াটি অনানুষ্ঠানিক হওয়ায় পক্ষগণ নিজেরা নিজেদের সমস্যা বা বিরোধ নিষ্পত্তিতে অধিক কথা বলার সুযোগ পান। এর ফলে পরস্পরের ভুল বোঝাবুঝির অবসানের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপণের সুযোগ কম: প্রচলিত পদ্ধতিগত কারণে অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ হয়ে থাকে, কিন্তু মধ্যস্থতার মাধ্যমে এক বৈঠকেই বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। আর এই পদ্ধতিতে আইনগতভাবে সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) দিন সময় প্রয়োজন হতে পারে। পক্ষগণ মতৈক্যে উপনীত হওয়ার পরে আদালত সে মর্মে ০৭ (সাত) দিনের মধ্যে ডিক্রি বা আদেশ প্রদান করতে পারেন। এতে মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপণের সুযোগ কম।
মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে কোর্ট ফি ফেরতের সুযোগ: মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে কোর্ট ফি পক্ষগণ কোর্ট ফি ফেরত পাবেন। যার ফলে পক্ষগণের অর্থের সাশ্রয় হবে।
মামলা পরিচালনায় ব্যয় হ্রাস: মধ্যস্থতার মাধ্যমে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম সময়ে মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হয়। ফলে মোকদ্দমার সার্বিক পরিচালনা ব্যয়সহ আইনজীবীর ফি বাবদ ব্যয় কম হয়।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্বল্প সময় ব্যয়: আদালতে বিচার বা সালিসের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা থেকে যায়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হলে রায়ের বিরুদ্ধে বা সালিসি রোয়েদাদের বিরুদ্ধে আপিল বা উচ্চ আদালতে রিভিশন হয়। এরপর আপিল বা রিভিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল বা লিভ টু আপিল হয়। আপিল বিভাগ যে রায় দিবেন তার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। এতে সব মিলিয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা হতে পারে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হলে সেই মধ্যস্থতার ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল বা রিভিশন রক্ষণীয় নয়। এর ফলে একদিকে যেমন বিরোধীয় বিষয়ের দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব, অন্যদিকে আপিল-রিভিশন ইত্যাদির আইনগত সুযোগ না থাকায় মামলার আর কোনো দীর্ঘসূত্রিতা থাকে না। এতে পক্ষগণের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হয়।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে জয়-পরাজয় থাকে না: মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে পক্ষগণ স্বাধীনভাবে নিজেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বিধায় এ ক্ষেত্রে পক্ষগণের মধ্যে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নের উদ্ভব হয় না। এই পদ্ধতিতে ‘win-win situation’ এর কারণে পক্ষগণ তাদের গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্থায়ী সমাধান হয়: মধ্যস্থতার মাধ্যমে পক্ষগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের সমাধান খুঁজে নেন বা বিরোধ মীমাংসা করেন বিধায় একই বিষয়ে পক্ষগণের মধ্যে বা তাদের উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে পুনরায় বিরোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ থাকে। ফলে বিরোধের একটি স্থায়ী ও সফল সমাধান হয় এবং পক্ষগণের মধ্যে সম্পর্ক অটুট থাকে।
সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার পর পক্ষগণ সম্মত হলে আদালত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মধ্যস্থতার আলোচনা শুরু করবেন অথবা মধ্যস্থতার জন্য সংক্ষিপ্ত বিরতিতে পক্ষগণের সুবিধামতো একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন। আদালত একইসময়ে পক্ষগণকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের অন্য যে সকল বিকল্প রয়েছে অর্থাৎ, নিযুক্ত আইনজীবীগণের মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ, জেলা জজ কর্তৃক প্রণীত প্যানেলের কোনো মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে মধ্যস্থতা অথবা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে মধ্যস্থতা ইত্যাদি বিষয় পক্ষগণকে বুঝিয়ে বলবেন এবং পক্ষগণ যদি এসব বিকল্পের যে কোনো একটিকে বেছে নেয়, তাহলে সে অনুযায়ী আদালত মধ্যস্থতার জন্য পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। তবে পক্ষগণের সঙ্গে ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট ছিল বা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে চাকরিরত আছেন এমন কোনও ব্যক্তিকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর অধীনে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এই আইনের ২২(২) ধারায় বর্ণিত ব্যক্তিদের মধ্য হতে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করতে হবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে আদালতের আদেশের দশ দিনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে মোকদ্দমার পক্ষগণ আদালতকে অবহিত করবেন। পক্ষগণ মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত করতে ব্যর্থ হলে আদালত পরবর্তী ০৭ (সাত) দিনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করবেন। মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হওয়ার ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে আদালত মধ্যস্থতা কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। এ কার্যক্রম যদি ষাট দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে মধ্যস্থতার অগ্রগতি বা যথাযথ কারণ বিবেচনায় অতিরিক্ত ত্রিশ দিন বর্ধিত করা যাবে। অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর বিধানমতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই আইনের ২২(৫) ও ২২(৬) ধারায় বিধান প্রযোজ্য হবে।
মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধটি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে মধ্যস্থতাকারী উভয় পক্ষ কর্তৃক গৃহীত শর্তাবলি উল্লেখপূর্বক একটি চুক্তি প্রস্তুত করবেন এবং পক্ষগণ, তাদের নিযুক্ত আইনজীবীগণ ও মধ্যস্থতাকারী তাতে স্বাক্ষর করবেন। এ চুক্তি দাখিলের সাত দিনের মধ্যে আদালত উক্ত চুক্তির আলোকে ডিক্রি বা আদেশ প্রচার করবেন। বিচারক নিজে আপস-মীমাংসা করে থাকলেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে মোকদ্দমার পক্ষগণ আদালতে দাখিলকৃত কোর্ট ফি ফেরত পাবেন। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে মামলাটি আগের অবস্থা থেকে চলবে।
মধ্যস্থতার এ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী পক্ষগণের বিরোধ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে পক্ষগণকে কোনোরুপ প্রভাবিত করবেন না। তিনি পক্ষগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবেন মাত্র। বিচারক নিজে মধ্যস্থতাকারী হলে এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে তিনি ওই মোকদ্দমার বিচার করবেন না। তিনি মোকদ্দমাটি উপযুক্ত একটি এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে বদলির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা জজের নিকট পাঠাবেন। কোনো আপিল মামলায় জেলা জজ মধ্যস্থতাকারী হলে এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে তিনি ওই আপিল মামলা বিচার না করে উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করবেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার যথাযথ কারণ উল্লেখপূর্বক আইন ও বিধি অনুযায়ী একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা আদালতে দাখিল করবেন।
মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় পক্ষগণের সাথে আলাপ-আলোচনা, বিবৃতি, স্বীকৃতি বা মন্তব্য গোপন রাখতে হবে এবং তা মোকদ্দমার কার্যক্রমে সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার বা বিবেচনায় নেওয়া যাবে না। মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার যে কোনো পর্যায়ে পক্ষগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে বা স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালত সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান মতে প্রয়োজনীয় আদেশ বা নির্দেশ দিবেন।