রাস্তায় পাশে ঝালমুড়ি খাবেন, ফল কিনবেন কিংবা মুচির কাছে জুতা পলিশ করবেন। এজন্য এখন আর নগদ টাকায় মূল্য পরিশোধ করতে হবে না। মোবাইল ফোনে শুধুমাত্র একটা অ্যাপ থাকলেই চলবে। কুইক রেসপন্স বা কিউআর কোডে দেওয়া যাবে পণ্যের দাম বা সেবার মূল্য। বড় শোরুম-চেইন শপ থেকে শুরু করে ফুটপাত ও ছিন্নমূল ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্য পরিশোধ হবে কিউআর কোডের মাধ্যমে।
প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে বুধবার (১৮ জানুয়ারি) মতিঝিলে এই ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গঠন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জন এবং কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সাধারণ মানুষকে জানাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে এ উদ্যোগের প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, পণ্য বা সেবা মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ, জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএস-গুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল। ছোট মার্চেন্টের (যেমন : ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, মুচি ইত্যাদি) পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে পৃথিবীব্যাপী লো-কস্ট সলিউশন প্রচলনের তাগিদ রয়েছে। কুইক রেসপন্স (কিউআর) ডিজিটাল পেমেন্ট এমনি একটি লো-কস্ট সলিউশন। বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক ও এমএফএস এর কিউআর কোড থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে, শুধুমাত্র ওই ব্যাংক বা এমএফএস গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা কিউআর উদ্যোগে ১০টি ব্যাংক, ৩টি এমএফএস ও ৩টি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম অংশগ্রহণ করেছে। বাংলা কিউআর-এ অংশগ্রহণকারী যে কোনও ব্যাংক ও এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী গ্রাহক যে কোনও ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন।
কিউআর কোড কেবলমাত্র একটি প্রিন্টেড ছবি হওয়ায় এই পরিশোধ ব্যবস্থায় মার্চেন্টের অংশগ্রহণের খরচ নগ, তাই এ পরিশোধ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গঠন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যাত্রা শুরু উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান ও এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মুনিরুল মওলা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এত দিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারতো। এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করতে পারবেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, ধরেন চা দোকানির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইসলামী ব্যাংকে আছে। ওই দোকানদার তো ইসলামী ব্যাংকের কিউআর কোড দেবেন। এখন আপনি চা বিস্কুট খেয়ে বিল দেবেন। কিন্তু আপনার অ্যাকাউন্ট ডাচ বাংলা ব্যাংকে। এখন কি করবেন? এটার সমাধান দেবে সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোড। এখান থেকে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ দোকানদারকে তার চায়ের বিল ডাচ-বাংলা কিউআর কোডে সরাসরি পরিশোধ করতে পারবেন।
বাংলা কিউআর কোডে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে এ উদ্যোগে যেসব ব্যাংক যুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো- ডাচ বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট ও কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে মতিঝিল এলাকায় চা দোকান, হোটেল, মুদি দোকান, মুচিসহ ভাসমান বিক্রেতাদের কিউআর কোড সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সেবা বিল পরিশোধ করছেন গ্রাহক।
মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে অনেক বছর ধরে জুতা পলিশ করে আসছেন শাপলা। ক্যাশলেস পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়ে শাপলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগে জুতা কালি কইরা মানুষ হাতে টাকা দিতো। সেসময় খুচরা টাকা না থাকলে জুতা কালি করার পরও কম টাকা নেওয়া লাগত। এহন আর খুচরা টাকার ঝামেলা নাই। কালি করা শেষে মোবাইলে টাকা দিয়া কাস্টমার চইলা যাইব, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বিকাশে টাকা আইয়া পরব। এইটা ভালোই হইছে, কামের ট্যাকাডা মোবাইলে জমা থাকব, এতে বাড়তি খরচ কিছুটা কমব।’ ক্রেতা তাকে মোবাইলে পেমেন্ট করেছে বলেও জানান শাপলা।
শাপলার পাশেই জুতা পলিশের দোকান রয়েছে রাকেশের। সেই দোকানেও এখন কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্ট সিস্টেম চালু হয়েছে। এ বিষয়ে রাকেশ বলেন, ‘অনেক সময় জুতা কালি করার পরে ভাংতি নাই বলে টাকা পরে দেবো বলে কাস্টমার চলে যেত। এই টাকা আর কোনো দিনই পাইতাম না। এখন মোবাইলে টাকা দেওয়ার সিস্টেম হওয়াতে ভালো হইছে। আর ভাংতির ঝামেলা নাই।আজ সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ২৮৯ টাকা মোবাইল পেমেন্ট পেয়েছে বলে জানান রাকেশ ।
এদিকে কিউআর কোড বা ক্যাশলেস পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ে মতিঝিল এলাকার পেয়ারা বিক্রেতা মোহাম্মদ শহীদ বলেন, এটা আমাদের জন্য খুব ভালো হইছে। অনেক সময় দেখা যায় ক্রেতার সঙ্গে খুচরা ১-২ টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়। এখন এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় খুচরা টাকা নিয়ে আর ঝামেলা হবে না। তবে টাকা ওঠানোর সময় ঝামালে না হলে আর সমস্যা নেই। এছাড়া মোবাইলে পেমেন্ট হলে ছেড়া টাকা নিয়ে আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।
‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় শ্রমনির্ভর অতিক্ষুদ্র ভাসমান উদ্যোক্তা (চা বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা), বিভিন্ন প্রান্তিক পেশায় (মুচি, নাপিত, হকার) নিয়োজিত সেবা প্রদানকারীদের বিল গ্রহণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল ও প্রাতিষ্ঠানিক করার উদ্দেশে ব্যক্তিক রিটেইল হিসাব খোলা হচ্ছে। এ হিসাবের মাধ্যমে যেসব ব্যবসায়ী, তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করবেন, তারা মাইক্রো-মার্চেন্ট হিসেবে গণ্য হচ্ছেন।
কিউআর পেমেন্ট কী?
কিউআর এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘কুইক রেসপন্স’। এটি একটি কন্টাক্টলেস পেমেন্ট পদ্ধতি, যেখানে কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত, সহজ ও সুলভ লেনদেন করা যায়।
কীভাবে করবেন কিউআর পেমেন্ট?
► মোবাইলে আপনার ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপ ডাউনলোড করুন
► ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপে পিন টাইপ করে লগ ইন করুন
► দোকান বা মার্চেন্ট আউটলেট প্রদর্শিত কিউআর কোড স্ক্যান করুন
► পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করার জন্য টাকার পরিমাণ লিখুন ৫. পিন/ওটিপি টাইপ করে লেনদেন সম্পন্ন করুন
► লেনদেন সম্পন্ন হবে এবং পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ডিজিটাল রিসিট পাবেন
কিউআর পেমেন্ট কেন করবেন?
ক্রেতার সুবিধা
► পেমেন্ট করতে নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না।
► ক্রেডিট/ডেবিট/প্রিপেইড কার্ড সঙ্গে না থাকলেও ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপের সঙ্গে পূর্বে সংযুক্ত কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করা যায়।
► ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এমএফএস ওয়ালেটের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যায়।
বিক্রেতার সুবিধা
► নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় না বিধায় ছেঁড়া-ফাটা বা জাল নোট গ্রহণের আশঙ্কা থাকে না
► কিউআর এর ইনস্টলেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ অনেক কম
► বড় বিক্রেতাদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিক্রেতারাও কম খরচে কিউআর ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার মূল্য গ্রহণ করতে পারবেন
অ্যাকাউন্টের পিন নাম্বার/ওটিপি কখনো কারও সঙ্গে (এমনকি আপনার ব্যাংক/এমএফএস) শেয়ার না করার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।