সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের সাধারণ এই দৃশ্য পাল্টাতে শুরু করে ২০১৩ সালের পর থেকে, যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি একপেশে হতে থাকে। বন্ধ হয়ে যেতে থাকে ‘সর্বদলীয় চায়ের আড্ডা’। কোথাও এ ধরনের আড্ডা চললেও আওয়ামী লীগের বাইরের তেমন কাউকে দেখা যেত না। ধীরে ধীরে কেবল সর্বদলীয় চায়ের আড্ডাই বন্ধ হয়নি, অধিকাংশ স্থানে বন্ধ হয়েছিল বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী নেতাকর্মীদের এক টেবিলে বসাও। এর পরের কাহিনী, ভোটবিহীন আওয়ামী সরকারের কথা সবারই জানা।
নানামুখী নির্যাতন আর ভোট দিতে না পারা— সবমিলে ধীরে ধীরে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে মানুষের মনে। এক সময় ক্ষোভে ফেটে পড়ে মুক্তিকামী মানুষ। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনার সঙ্গে পালিয়ে যায় মাঠের আওয়ামী লীগও।
ফলে দীর্ঘদিনের ভয়ের সংস্কৃতির পর আবারও জমে উঠতে শুরু করেছে চায়ের দোকানের সেই রাজনৈতিক আড্ডা। পার্থক্য শুধু, এখন আর সেই আড্ডায় থাকে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
গত ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার সোনবাড়ীয়া বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন সমর্থক। আড্ডার পাশাপাশি রাজনৈতিক আলাপ করছিলেন। বিএনপির এক সমর্থক বলছিলেন, ‘যতদিন নির্বাচন না হবে ততদিন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভালো হবে না। সেই ২০০৮ সালে শেষবার ভোট দিছি। এরপর ভোট দেওয়ার দরকারই পড়েনি। এবার ভোট দিতে চাই। কিন্তু কবে হবে ভোট? কিছু বুঝতেছি না। সংস্কারের কথা বলে সরকার ভোট পেছাবে না তো?’
পাশে থাকা এক জামায়াত সমর্থক বলেন, ‘ইউনূস সাব সারা দুনিয়ার সম্মানিত ব্যক্তি। সবাইকে তো দেখলাম, উনি ক্ষমতায় থাকলে দেশের মঙ্গল হতে পারে। সংস্কার কমিশন করছে কয়েকটা। আগে কিছু সংস্কার হোক। নির্বাচন ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন আসুক। ভোট এক-দুই বা তিন বছর দেরিতে হলে অনেক ক্ষতি হবে না। হাসিনা তো ভোটই দিতো না।’
তার কথার জবাবে পাশে থাকা আরেকজন বলেন, ‘ড. ইউনূস সম্মানিত ব্যক্তি। ভোটে দাঁড়ালে পাস করতে পারে। দেশের মঙ্গলে ক্ষমতায় যদি উনাকে থাকতেই হয়, তাহলে ভোটে দাঁড়াক। নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে আরও ভালো। মানুষ অনেকদিন ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় না। মানুষ ভোট দিতে চায়।’
এসব আলোচনা যখন চলছিল, সেখানে থাকা কয়েকজনের একই প্রশ্ন ছিল, ‘ভোট কবে হবে? আগামী ডিসেম্বর নাকি জুনের ভেতরে? নাকি ৫ বছর পর?’
শুধু তারা নয়, গ্রামের আরও অনেক মানুষের একই প্রশ্ন— ভোট কবে হবে? রাজধানীবাসীও জানতে চায় ভোট আসলে কবে।
রাজধানীর কাঁঠালবাগানে বসবাস করেন শিবলি মনির। বেসরকারি চাকরিজীবী। রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। দেশ-দুনিয়ার খবর রাখেন নিয়মিত। গল্পে গল্পে শিবলি বলছিলেন, ‘এনসিপি আর জামায়াতের কথা শুনলে মনে হয়, ভোট হতে দেরি আছে। আবার বিএনপির কথা শুনলে মনে হয়, ডিসেম্বরে ভোট আয়োজন করতে দলটির যা করা দরকার, তাই করবে। অন্যদিকে এটাও মনে হয়, এনসিপি আর জামায়াত মিলে বিএনপি ঠেকাও বা ভোট ঠেকাও পথে হাঁটবে। অন্যদিকে সরকার নির্বাচনের নির্ধারিত সময় ঘোষণা করে না। মূলত ভোট কবে হবে, তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি।’
যেসব সাংবাদিক নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তাদের অনেকেরও একই জিজ্ঞাসা। আসলে ভোট কবে হবে? কথা প্রসঙ্গে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সাবেক সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরেই হবে। কখনও মনে হয়, এপ্রিলের শেষে। আবার কখনও মনে হয় যেকোনো প্রক্রিয়ায় নির্বাচন আরও বিলম্বিত করা হতে পারে। তবে নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন হলো সবচেয়ে বড় সংস্কার। গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধাপ।’
যদিও সরকার বলছে, স্বল্পমেয়াদি সংস্কার হলে ডিসেম্বরে আর দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার হলে আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে সরকারের গঠিত কমিশন ঐকমত্য কমিশনের কাছে একটি সংস্কার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে।
এ বিষয়ে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, সংস্কার ও পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার শেষে জাতীয় নির্বাচনের কথা। জামায়াত ইসলামীও বলছে, সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা।
অন্যদিকে বিএনপির দাবি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। দলটি বলছে, বেশি সংস্কার করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার।সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচন হতে হবে যথাসময়ে।
এই যখন পরিস্থিতি তখন, ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন যেন বিলম্বিত না হয় সেজন্য সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি সংস্কার কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনের অনেকগুলো ধারায় আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কী সংস্কার হবে বা হবে না, তা জানার আগে ইসি নতুন দলের নিবন্ধনেরও আহ্বান করেছে। নির্বাচনি আচরণ বিধিমালার খসড়াও প্রস্তুত করেছে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে ইসি। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের নীতিমালা নিয়েও কাজ শুরু করেছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সংস্কার প্রস্তাব পাশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনের পরিবর্তন এনে একটি খসড়া প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইসি। ঈদুল ফিতরের আগে কেবিনেট মিটিংয়েও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে উপদেষ্টা পরিষদের এজান্ডাতেও বিষয়টি নথিভুক্ত করা হয়। যদিও পরে এজান্ডা থেকে বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। ইসি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইসির ধারণা, এসব কাজ শুরু না করলে নির্বাচন আয়োজন করতে দেরি হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনের একটি প্রস্তাব আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। ঈদের আগে কেবিনেট মিটিং হয়েছে। আমরা এখনও অনুমোদন পাইনি। অনুমোদন পেলে পরে এ বিষয়ে কাজ করব। আর যদি অনুমোদন না পাই, তাহলে বিদ্যমান যে আসন বিন্নাস রয়েছে, সেই বিন্যাসের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
এদিকে প্রবাসী নাগরিকদের ভোটের আওতায় আনার চেষ্টা করছে ইসি। নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, তিনটি পদ্ধতি সামনে রেখে আমরা প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। প্রতিটি পদ্ধতিরই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার সুবিধাও রয়েছে। যদি প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনতে হয় তাহলে কোনো না কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যদি মনে করি সারা পৃথিবীর সব দেশের প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনব, তাহলে ভোটের আগে সব দেশে প্রস্তুতি হিসেবে মক ভোটিং করতে হবে।
এখনও সংস্কার প্রস্তাব পাস হয়নি। সংস্কার কমিশন চায়, স্থানীয় নির্বাচন আগে হোক। সব মিলিয়ে ভোট বিলম্বিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখেন কিনা, এমন প্রশ্নে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের ভোটের কথা ভাবছিই না। আমরা আমাদের চেষ্টা চালাচ্ছি। একটি দিনও আমরা নষ্ট করিনি। আমরা ডিসেম্বরকে ধরেই সংসদ ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইনশাল্লাহ সবকিছু সময়মতো হয়ে যাবে।’
এদিকে সংস্কার প্রস্তাব পাস হওয়ার আগেই নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তিসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। ইসির দাবি, ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হলে জুন-জুলাইয়ে সব কাজ শেষ করতে হবে।
অন্যদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে, সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দল নিবন্ধনসহ নানা উদ্যোগ সাংঘর্ষিক। সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে এসব উদ্যোগ কাম্য নয়। কারণ একটা সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। এটি নিয়ে তাদের সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা করা দরকার ছিল বলে মনে করি।
গত ১৭ মার্চ নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের কাছে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কতিপয় সুপারিশের বিপরীতে নির্বাচন কমিশনের মতামত বা অভিমত প্রেরণ’ শিরোনামে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দেওয়া সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে পৃথক কমিশন গঠন, এনআইডির জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন, ইসির শাস্তিসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়ে সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করেছে ইসি।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব এবং যা বলছে ইসি
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল গেজেটে প্রকাশের পূর্বে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ‘সার্টিফাই’ করে তা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, এটি অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা। নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়েই গেজেট প্রকাশ করে। প্রিজাইডিং অফিসার এবং রিটার্নিং অফিসারকে আইনুযায়ী সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া আছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই গেজেট প্রকাশ করা হয়। ইসির কাছে অন্য কোনো আইনানুগ মাধ্যম নেই যার ভিত্তিতে প্রত্যয়ন দেওয়া যাবে।
সংস্কার কমিশন বলেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করা ও কমিশন/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে উক্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করার বিধান করার জন্য।
তবে ইসি বলছে, এই বিধান করা হলে পরাজিত রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনকে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংস্কার কমিশন প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা বিধানে আইন ও বিগত কমিশনের আমলে নিবন্ধনপ্রাপ্ত দলগুলোর নিবন্ধন মূল্যায়ন সাপেক্ষে বাতিলের সুপারিশ করেছে।
কিন্তু ইসির অভিমত হলো বিদ্যমান আইনে প্রার্থী ও এজেন্টদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া কোনো একটি বছরে প্রাপ্ত দলের নিবন্ধন বাতিল হলে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠবে।
সংস্কার কমিশন বলছে, আউয়াল কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিয়েছে, যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা।
তবে ইসি বলছে, একটি বছর ধরে করলে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হতে পারে। তবে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও উপাত্ত থাকলে আলাদা কথা।
সংস্কার কমিশন নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের (যদি না হয়, তাহলে বিদ্যমান সংসদের অনুরূপ) স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপনের বিধান করার প্রস্তাব করেছে৷
ইসি বলছে, এটি সংসদীয় কমিটির কাজ নয়। এটি নির্বাহী কাজ। এতে করে উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে। কাজের ধাপ এবং সময় বাড়বে।
সংস্কার কমিশন বলছে, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান করা।
নির্বাচন কমিশন বলছে, এই সুপারিশের ফলাফল খারাপ হবে কারণ ‘ব্যর্থ’ শব্দটির বিবরণ/ব্যাখ্যা আপেক্ষিক। কমিশনসমূহ ‘প্রতিহিংসার’ আশঙ্কায় শক্ত অবস্থান নিতে পারবে না। অনুরূপ বিধান স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : রিটার্নিং কর্মকর্তা/সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ
সংস্কার কমিশন নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার সুপারিশ করেছে। এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক কমিশনের কর্মকর্তা পাওয়া না গেলে প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডার থেকে নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছে।
আর ইসি বলছে, সক্ষমতা ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে অনুশীলন করতে হবে।
নির্বাচন-সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম কমিশনের যৌথ সিদ্ধান্তে পরিচালিত করার বিধান করার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি বলছে, কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাস্তবসম্মত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মেয়াদ চার মাস নির্ধারিত করে এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তাবের বিষয়ে ইসি বলছে, এতো কম সময়ে নির্বাচন করলে তা সুষ্ঠু হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে এক বছরের মতো সময় প্রযোজন।
ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করার প্রস্তাবকে স্বাধীনতাকে খর্ব করার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে ইসি।
এদিকে সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০২৫ (প্রস্তাবিত খসড়া) প্রস্তাব করেছে। এতে বলা হয়েছে, পার্বত্য এলাকার তিন জেলাকে তিনটি সুরক্ষিত সংসদীয় আসন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অন্যান্য জেলায় যেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস আছে সেক্ষেত্রে ওই নৃ-গোষ্ঠীকে বিভক্ত না করে অর্থাৎ একটি ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে একই সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এছাড়া মেহেরপুর, পিরোজপুরসহ ছোট জেলাগুলোর জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি আলাদা জনসংখ্যা কোটা বিবেচনা করে ১০ শতাংশের অধিক বিচ্যুতি না করে ওইসব জেলার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। বৃহত্তর জেলার জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি আলাদা জনসংখ্যা কোটা বিবেচনা করে ১০ শতাংশের অধিক বিচ্যুতি না করে ওইসব জেলার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে এ বিচ্যুতি ১৫ শতাংশের অধিক করা যাবে না।
এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি বলছে, এই প্রস্তাব যৌক্তিক না। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাছ থেকেও সংরক্ষিত আসনের দাবি আসতে পারে। এতে অনেক বেশি সংখ্যক আসনের সীমানা কাটা-ছেঁড়া করতে হবে, সংখ্যাটি ২০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমেয়। এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব বিঘ্নিত হবে। ক্রমাগতভাবে শহর এলাকায় আসন সংখ্যা বাড়তে থাকবে। প্রশাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের সাথে এই ধারণা সাংঘর্ষিক।
ইসি মনে করে ভৌগোলিক অবস্থা ও অবস্থান এবং জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা, প্রশাসনিক সুবিধা ও বাউন্ডারি বিবেচনায় আসন বিন্যাস হওয়া যৌক্তিক। এক্ষেত্রে ভোটার সংখ্যায় ‘যতদূর সম্ভব’ সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়া এনআইডির জন্য পৃথক কমিশন গঠন, প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণার বিধান, মনোনয়নপত্র, নির্বাচনি অপরাধে শাস্তির বিধান, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন, ইসির আর্থিক স্বাধীনতা, ইসির অপরাধের শাস্তি, ইসির আচরণবিধি, ইসি সচিবালয় আইন সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলোকেও হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করছে ইসি।
নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ তার চিঠিতে একটি পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, দেশের কোনো নাগরিকই আইনের ঊর্ধ্বে নন। কমিশনের সদস্যদের কেউ শপথ ভঙ্গ করলে বা অসদাচারণ করলে মেয়াদকালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে এবং মেয়াদ পরবর্তী সময়ে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এখানে আলাদাভাবে কারাদণ্ডের মতো বিধান রাখা এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।