পৃথক আইনে গঠিত সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অথচ প্রতিষ্ঠানটির অতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা নেই। সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া ‘ভাড়াটে’ কর্মকর্তাদের দিয়ে। যদিও এসব পদে দায়িত্ব পালনে দুদকের রয়েছে অনেক জ্যেষ্ঠ, যোগ্য ও দক্ষ জনবল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বছরের পর বছর তাদের পদোন্নতি বন্ধ আছে।
জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আইন ও বিধি মেনেই দুদকে আসেন বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। কেউ প্রেষণকালের অতিরিক্ত ৪-৬ মাস সময় থাকলে আইন বা বিধি লঙ্ঘন হয় না। এটা একটা প্র্যাকটিস। এমন কেউ এখন দুদকে আছে কিনা-তা আমার জানা নেই। তা খোঁজ নিয়ে দেখব।’ দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারও সঙ্গে কারও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বের কিছু নেই। কর্মকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশন অনেক প্রতিষ্ঠানেই আছে।’ আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কারও পদোন্নতি আটকে নেই। পদোন্নতি চলমান। পর্যায়ক্রমে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হচ্ছে।’
জানতে চাইলে আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, দুদক যাতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় সেটি স্পষ্টতই আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্ত। এটাও আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্ত যাতে দুদক আমলাতন্ত্রের উঁচুস্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা না করে। যে ধরনের ব্যক্তিদের কাছ থেকে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়, সেই তালিকা পর্যালোচনা করলেই দুদক কিভাবে চলছে তা আরও স্পষ্ট হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাজনৈতিক বা সরকারি দলের দুর্নীতি দমনে দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া দুদক কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে না। দুদকের প্রধান কাজ অনুসন্ধান ও মামলা করা। এজন্য আইন জানা লোক দরকার। কিন্তু এখন দুদকে যারা উচ্চপর্যায়ে কর্মরত তাদের মধ্যে আইন জানা লোক খুব কম। ফলে যেসব মামলা করা হয় তা খুবই দুর্বল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ পরিচালক (প্রশাসন), উপ-পরিচালক (প্রশাসন), পরিচালক (বিশেষ তদন্ত ১) পরিচালক (ব্যাংক), পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) বিভিন্ন পদে কর্মরত অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তার সবাই প্রেষণে আছেন। এরমধ্যে কাস্টমসের ১, গণপূর্তের ২ ও পুলিশের ১ জন ছাড়া বাকি সবাই প্রশাসন ক্যাডারের। মহাপরিচালক ৮ জনের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ৭ জন। একজন বিচার বিভাগের। ৩৭টি পরিচালক পদের ১২টিতে উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা প্রেষণে কর্মরত। ফাঁকা আছে ৬টি পরিচালক পদ। দুদকের অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা এ পদে পদোন্নতির যোগ্য হলেও তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। উপ-পরিচালক পদেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। উপ-পরিচালক পদ ফাঁকা আছে ১২১টি। সহকারী পরিচালক পদ ফাঁকা ২৩৩টি। ৩০১টি উপ-সহকারী পরিচালক পদও ফাঁকা। এসব পদের বিপরীতে পদোন্নতির জন্য দুদকের যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।
দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে, উল্লিখিত কর্মকর্তাদের অনেকেই তিন বছরের জন্য প্রেষণে নিয়োগ পেলেও আছেন বছরের পর বছর। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. আওয়াল ৫ বছর, কমিশনার মো. জহুরুল হকের একান্ত সচিব মো. রবিউল ইসলাম ৭ বছর, কমিশনার (অনুসন্ধান) মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক খানের একান্ত সচিব মো. শফিউর রহমান ৪ বছর ও চট্টগ্রাম ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. ইউসুফ ৪ বছর ধরে দুদকে আছেন। এছাড়া মহাপরিচালক (আইসিটি ও প্রশিক্ষণ) একেএম সোহেল, মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান, বরিশাল ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফজলুল হক পাভেলের (সাবেক পিএস টু চেয়ারম্যান এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হিসাবেও তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন) প্রেষণকাল শেষ হলেও তারা দুদক ছাড়েননি। এর আগেও দুদকের সচিব পদে প্রেষণে যোগদান করেছিলেন মোস্তফা কামাল। এখান থেকেই সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অবসরে যান। মোখলেসুর রহমান নামের একজন উপসচিব টানা পাঁচ বছরের বেশি সময় দুদকে ছিলেন। তিনি তিনজন চেয়ারম্যানের পিএস হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
দুদকের বিধিতে (২২-এ) বলা আছে, প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা, কর্মচারীরা অনধিক তিন বছর পর্যন্ত থাকতে পারবেন। তিন বছরের অধিক হলে তারা নিজ সংস্থায় ফেরত যেতে বাধ্য। অথচ অনেক কর্মকর্তা প্রেষণে যোগদানের পর তার মূল চাকরিতে পদোন্নতি পান। পদোন্নতি পাওয়ার পরেও বছরের পর বছর দুদকের শীর্ষ পদগুলোতে প্রেষণে বহাল থাকেন। যা দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা-২০০৮ এর বিধি নং ০৮(২) (ক) সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের ভাষ্য-দুদক আইনের ৩(২) ধারায় বলা আছে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হইবে।’ এমনকি প্রস্তাবে বিষয়টি বলা আছে। অথচ উক্ত আইন ও বিধি ভঙ্গ করে প্রশাসন ক্যাডারের এত সংখ্যক কর্মকর্তা প্রেষণে কাজ করলে দুদক নামের প্রতিষ্ঠানটির স্বাতন্ত্র্য থাকে না।
পদোন্নতি বঞ্চিতদের অভিযোগ, দুদকের নিজস্ব সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ‘আমলাতান্ত্রিক’ জটিলতার বেড়াজালে আটকে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দিয়ে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন জায়গায় কাজ করানো হচ্ছে। ১০-১২ বছর ধরে একই পদে কাজ করছেন অনেক কর্মকর্তা। পদোন্নতি আটকাতে অতি সম্প্রতি একটি সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। তাতে অনেক কঠোর নিয়ম, কানুন সংযুক্ত করা হয়েছে। যাতে কেউ পদোন্নতি পেতে না পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, দুদকের দু’জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, দুদক ব্যতীত দেশের অন্যান্য অনুসন্ধান ও তদন্ত সংস্থায় বাইরের কর্মকর্তা প্রেষণে আসার কোনো নজির নেই। এতে অনুসন্ধান ও তদন্তের গোপনীয়তা নষ্ট হয়। অনেক সময় প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা নিজেদের লোকজনকে রক্ষা করতে ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে কাজ করেন। দুদক এখন প্রশাসন ক্যাডারের স্বার্থ রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম। যা দুদক আইনের বর্ণিত নিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক প্রতিষ্ঠার পর ১৮ বছরে মহাপরিচালক পদে একজন ও পরিচালক পদে ৩ জন পুলিশ সদস্য প্রেষণে দুদকে নিয়োগ পান। তারা নির্ধারিত ৩ বছরও টিকতে পারেননি। এছাড়া অতিরিক্ত এসপি পদমর্যাদার আরও ৫ পুলিশ সদস্য দুদকে নিয়োগ পেলেও প্রেষণকাল শেষ না হতেই তারা নিজ বাহিনীতে ফিরে যান। আর কয়েক বছর আগে একযোগে ১০ জন পুলিশ সদস্যকে দুদকে প্রেষণে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে তা কার্যকর হয়নি। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা দুদক নিয়ন্ত্রণে রাখতেই অন্য কোনো সংস্থার কর্মকর্তাদের সেখানে টিকতে দেন না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
দুদক বিধি ও চাকরি বিধি লঙ্ঘন দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘বৃহত্তর অর্থে এটা দুর্নীতি। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এটা আইনের লঙ্ঘন ও অপরাধ। যে শর্তে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটা হচ্ছে না।’ আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় সবকিছু তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে স্বগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এক মাপকাঠিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসন ক্যাডারের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে এই গোষ্ঠীটিই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’ দুদক বিধি-৫ এ বলা আছে, ‘আইনের তফশিল ও উল্লিখিত অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইর জন্য কমিশন তার প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয় ও জেলা কার্যালয়গুলোর জন্য এক বা একাধিক কমিটি গঠন করতে পারবে। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটি কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের তিনজন কর্মকর্তা সমন্বয়ে গঠিত হবে।’
জানা গেছে, প্রধান কার্যালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটির (যাবাক) সভাপতি মহাপরিচালক (আইসিটি ও প্রশিক্ষণ) একেএম সোহেল, সদস্য সচিব উত্তম কুমার মণ্ডল এবং সদস্য ইমরুল কায়েস। তারা তিনজনই প্রেষণে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা। দুদক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এই যাবাক কমিটি প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি কার্যকর হচ্ছে না। একাধিক তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্মকর্তার ভাষ্য-প্রশাসন ক্যাডারের বদলে সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তা, জুডিশিয়ারি ও পুলিশ ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়া হলে অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলার সফলতা আরও গতিশীল হতো। জুডিশিয়ারি, পুলিশ ও দুদকের কাজ একই ধরনের।