ভারতের সেনা সর্বাধিনায়কের স্বীকারোক্তি, রাজনৈতিক চাপে মোদি সরকার

কাশ্মীরের পহেলগামে হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে এপ্রিলে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়৷ ভারতের অপারেশন ‘সিঁদুরের পর’ পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের সামরিক বাহিনী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে৷ পাকিস্তান দাবি করে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রাফাল বিমান গুলি করে নামিয়েছে তারা৷ এ নিয়ে নয়াদিল্লি এতদিন নীরব থাকলেও মুখ খুলেছেন ভারতের সেনা সর্বাধিনায়ক৷

যা বলছেন ভারতের সেনা সর্বাধিনায়ক

গত ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি ঘোষিত হয়৷ তারপর তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও ভারত সরকার এ ব্যাপারে কিছু বলেনি৷ সেনার পক্ষ থেকেও কিছু বলা হয়নি৷ অবশেষে মুখ খুললেন ভারতের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বা সর্বাধিনায়ক অনিল চৌহান৷

সিঙ্গাপুরে সাংগ্রিলা ডায়ালগে অংশগ্রহণ করার অবসরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন৷ ব্লুমবার্গ টিভির প্রশ্নে চৌহান কার্যত স্বীকার করেন, অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানের আঘাতে ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে৷

সর্বাধিনায়ককে প্রশ্ন করা হয়, পাকিস্তান কি ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি চৌহান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়া বা তার সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ কেন সেটা ধ্বংস হল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷”

সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তার মানে অন্তত একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের হামলায় ধ্বংস হয়েছিল? এর জবাবে সংক্ষেপে ‘হ্যাঁ’ বলেন চৌহান৷ তার ভাষায়, ‘‘গোটা ঘটনার ইতিবাচক দিক, আমরা কৌশলগত ভুলটা দ্রুত ধরে ফেলেছি৷ ভুল শুধরে নিয়ে দুদিনের মধ্যে আবার নতুন কৌশল প্রয়োগ করেছি৷”

ব্লুমবার্গের সাংবাদিক সরাসরি প্রশ্ন করেন, “পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের হামলায় ভারতের অন্তত ছয়টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে৷ এটা সত্যি?” এই প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের দাবি খারিজ করে দেন চৌহান৷

বিরোধীদের সমালোচনা

সেনা সর্বাধিনায়কের মন্তব্য সামনে আসার পরে বিরোধীরা নিশানা করেছে মোদি সরকারকে৷ তারা প্রশ্ন তুলেছে গোপনীয়তা নিয়ে৷ দেশবাসীকে এই বিষয়ে না জানানোর উদ্দেশ্য নিয়েও সমালোচনা করেছে তারা৷

দেশের মানুষের আগে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে তা কেন জানানো হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সাগরিকা ঘোষ৷ তিনি সমাজমাধ্যমে প্রশ্ন করেন, “দেশি সংবাদমাধ্যম কেন প্রথমে এই খবর বের করবে? এই তথ্যগুলো কেন প্রথমে ভারতীয়দের, দেশের সংসদকে ও জনপ্রতিনিধিদের জানানো হয়নি?”

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের বক্তব্য, ‘‘সর্বাধিনায়কের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করা উচিত সংসদের বিশেষ অধিবেশনে৷ কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশকে বিভ্রান্ত করেছে৷ যুদ্ধ নিয়ে ধোঁয়াশা এখন অনেকটাই স্পষ্ট৷”

কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করে কংগ্রেস সভাপতি বলেন, ‘‘আমাদের পাইলটরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন৷ আমাদেরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ আমরা পাইলটদের সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানাই৷”

কংগ্রেসের দাবি, কারগিল যুদ্ধের পরে যেভাবে পর্যালোচনা কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে৷ তারা যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি তদন্ত করে দেখবে৷

এছাড়াও কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের প্রশ্ন রয়েছে যুদ্ধবিরতি ঘিরে৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি হয়েছে কি না, এ নিয়েও সরকারের জবাব চাইছে তারা৷ এ বিষয়েও ব্লুমবার্গ টিভি সেনা সর্বাধিনায়ককে প্রশ্ন করলেও সরাসরি জবাব দেননি চৌহান৷

খাড়গে বলেন, ‘‘যুদ্ধবিরতির শর্ত কী ছিল? তাহলে কী কোথাও সমঝোতা হয়েছে? আমাদের কি আপস করতে হয়েছে?”

শুক্রবার ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি বাণিজ্য বন্ধের কথা বলে দুই দেশকে সংঘর্ষবিরতির পথে নিয়ে এসেছেন৷ তার বক্তব্য, “আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম, এমন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালাতে পারবো না, যারা পরস্পরের দিকে গুলি ছুঁড়ছে৷ পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটছে৷ এটা বুঝতে পেরে ওরা সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছেন৷”

ট্রাম্পের বক্তব্য, ‘‘যুদ্ধ থামাতে সক্ষম হওয়া আমার কাছে গর্বের৷ ওরা যেটা বুলেট দিয়ে করতে চেয়েছে, আমরা বাণিজ্য দিয়ে করেছি৷” তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে সেনা সর্বাধিনায়ক মানতে চাননি৷

বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “পারমাণবিক যুদ্ধ ও সাধারণ সংঘর্ষের মধ্যে অনেক তফাৎ৷ পরমাণু যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেকগুলি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়৷ পরমাণু যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি আদতে তৈরি হয়নি৷”

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমাদের বিমান বাহিনীর যিনি প্রধান, তিনি বারবার বলেছেন, যে সমস্ত বিমানের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সময় মতো আসেনি৷  এরপরই অনিল চৌহানের এই স্বীকারোক্তিতে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের প্রতিরক্ষা কাঠামো যতটা সুরক্ষিত ভাবা হচ্ছিল, ততটা হয়তো সুরক্ষিত নয়৷ আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে পাকিস্তানের চীনা বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেম কাজ করেনি৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে চীনা যুদ্ধবিমান খুবই কার্যকরী৷ সেগুলো আমাদের যুদ্ধবিমান ভেঙে দিয়েছে৷ এখনো স্পষ্ট নয় যে কোন বিমান ভেঙে পড়েছে, অত্যাধুনিক রাফাল নাকি প্রাচীন মিগ৷”

তবে এই তথ্য প্রকাশ্যে না এনে কি কেন্দ্র ঠিক কাজ করেছে? সমর-সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, “যতদিন অপারেশন সিঁদুর চলছিল, ততদিন এটা নিয়ে সেনাবাহিনীর তরফে বিবৃতি দেওয়া কোনো উচিত কাজ নয় বলেই মনে হয়৷ যতদিন অপারেশন চলে বা সেনাবাহিনী এ ধরনের কাজ করে, ততদিন তারা এসব বিষয় নিয়ে জানায় না৷ ফলে অনিল চৌহান যে দেরিতে মুখ খুলেছেন, এটা অস্বাভাবিক নয়৷”

রাজাগোপালের বক্তব্য, “যুদ্ধ যেহেতু শেষ হয়নি, তাই সরকারের কাছে আমরা এ ব্যাপারে বিশদ তথ্য দাবি করতে পারি না৷ জাতীয় সুরক্ষা বা সেনাবাহিনীর নৈতিক বলের কথা ভেবে সরকার এসব তথ্য নাও দিয়ে থাকতে পারে৷”

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যুদ্ধের সময় এসব বলা যায় না, সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে৷ জনগণের মধ্যেও একটা অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে এটা ভেবে যে, আমাদের যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হলো, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করছে না৷ এখন সংঘর্ষবিরতি হয়ে গিয়ে, তারপরে বিষয়টি বলা হয়েছে৷”

রাজাগোপাল বলেন, ‘‘সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কর্তার বক্তব্যের পার্থক্য আছে৷ বিমান কেন ধ্বংস হয়েছে, সরকার সেটা সময় মতো মানুষকে জানাবে৷ ভারত সরকারের উচিত, দেশের মানুষকে এ সব বলা অথবা কাউকে না বলা৷ দেশের মানুষ ভাবতেই পারেন যে, বিদেশি সংবাদমাধ্যম সরকারের কাছে যতটা আপন, ততটা দেশের মানুষ নন৷ এ ধরনের চিন্তাধারা মানুষকে অনেক সময়ে বিভ্রান্ত করতে পারে৷ বিরোধীরা সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন এটাকে ব্যবহার করার৷”

নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে?

পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সেনা সর্বাধিনায়কের মন্তব্য নির্বাচনি রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে৷

রাজাগোপাল বলেন, ‘‘২০১৯-এ বালাকোট অভিযান করেই বিজেপি জিতেছিল৷ রাজনীতিতে সরকারের বীরত্বের একটা ভূমিকা আছে৷ মানুষ খেতে পাক বা না পাক, চাকরি পাক বা না পাক, দেশ অনেকটা এগিয়েছে, এটা মানুষকে গর্বিত করে৷ যারা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভোটের সুফল পায়, তাদের ক্ষেত্রে মানুষের এই চিন্তাভাবনা অনেক ভোট এনে দেয়৷ এবার যদি দেখা যায় এটা অনেকটাই ফাঁপা চিন্তাভাবনা, তাহলে ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়বে৷”

সুমন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘বিরোধীদের এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা আছে যে, এত দাম দিয়ে রাফাল কিনে কতটা যুদ্ধে কাজে লাগলো৷ রাফাল নিয়ে কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন করে আসছে৷ ২০১৯-এর নির্বাচনের সময়ে তাদের বক্তব্য ছিল, রাফাল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে৷ রাফাল কেনাটা খুব উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ছিল না৷ ফলে অনিল চৌহানের বক্তব্য রাফাল নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিতে পারে বা কংগ্রেসের প্রশ্নচিহ্নকে আরো সংগঠিত করতে পারে৷”

মইদুল বলেন, ‘‘উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ক্ষেত্রে পাকিস্তান নিয়ে একটা উদ্বেগের জায়গা আছে৷ পাকিস্তানের আক্রমণে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ তাদের সমাজ হিন্দু–মুসলমানে অনেকটাই বিভাজিত৷ পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতে হওয়ায় যুদ্ধের জিগির এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ বিহারের ক্ষেত্রে নীতীশ কুমার ফ্যাক্টর৷ সেখানে বিজেপি তার জোটসঙ্গী৷ পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত ও অনিল চৌহানের স্বীকারোক্তির ফলে নীতীশের নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট বিধানসভা নির্বাচনে কতটা সুফল পাবে, সেটা বলা মুশকিল৷”