ইসলামী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বেশ আগে থেকে নানা অনিয়ম হলেও এত দিন চুপ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টানা এক দশক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক থাকলেও ২০২০ সালের মার্চে হঠাৎ তা প্রত্যাহার করে নেয় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর পর থেকে দ্রুত ঋণ বাড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংক। আবার এ ব্যাংক থেকে বেনামে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে সন্দেহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই একটি বিভাগ গত আগস্টে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। এরপর গত তিন মাসে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের হওয়ার পর এখন হঠাৎ তৎপরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনিয়মের বিষয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সম্প্রতি ব্যাংকটিতে তদন্ত শুরু করেছে। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী, অডিট ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যবিবরণী আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট-সুপারভিশন বিভাগে। রাজশাহীভিত্তিক ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী নাবিল গ্রুপের নামে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সন্দেহজনকভাবে ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি নজরে আসার পর তা ঠেকানোর চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিভাগ। এরই মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে নাবিল গ্রুপের ঋণ বেড়ে হয় ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। আর গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে তাদের ঋণ আরও বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মানে গত আট মাসে শুধু নাবিল গ্রুপের ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এর আগে গত ৩ অক্টোবর ‘বেনামি সন্দেহে তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকার ঋণ’ শিরোনামে সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্রথম পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির মালিকানায় পরিবর্তন আসে। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসে ব্যাংকটি। মালিকানা পরিবর্তনের পরও ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক ছিলেন। সাধারণত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (সাবেক মহাব্যবস্থাপক) পদমর্যাদার ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময়ের পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে থাকা মো. রেজাউল ইসলাম ২০২০ সালের ১৯ মার্চ নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি পেলে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আর কাউকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পর্যবেক্ষক প্রত্যাহারের পর ইসলামী ব্যাংকের ঋণ দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এসব ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেনামে নেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জি এম আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কেউ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করে নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন সদস্যের দল কাজ করছে। গত সোমবার শুরু হওয়া চার দিনের পরিদর্শন শেষ হবে আজ। এরই মধ্যে ব্যাংকটির ৫০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের সব ঋণের তথ্য চাওয়া হয়েছে। নতুনভাবে সৃষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণছাড় আপাতত স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদিত সীমার চেয়ে এরই মধ্যে বেশি ঋণ বের হয়ে গেছে।
প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারণা করছে, রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে ৮টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করা ৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩১শ কোটি টাকা গ্রুপটির প্রকৃত ঋণ। বাকি ৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার সুবিধাভোগী অন্য কোনো পক্ষ। এ ছাড়া একেবারে নতুন কোম্পানি মেডিগ্রীন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে গত অক্টোবরে ৯০০ কোটি; এসএস স্ট্রেইট লাইন ইন্টারন্যাশনালের নামে গত সেপ্টেম্বরে ৯০০ কোটি এবং এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে গত অক্টোবরে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ বেনামি ঋণ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংক একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সমপরিমাণ ঋণ দিতে পারে। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের মূলধনের বিপরীতে একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্পগোষ্ঠীর চার প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই একক গ্রুপকে সীমার বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।
জানা গেছে, এ বছরের ২১ মার্চ ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ সভায় নাবিল গ্রুপের ঋণসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এর কিছুদিন না যেতে নাবিল ক্রেইন ক্রপস নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে গত জুনে গুলশান শাখার মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা। এভাবে ঋণ সৃষ্টির বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় অধিকতর পরিদর্শনের জন্য দুটি বিভাগে পাঠানো হয়। পরিদর্শনের জন্য পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত কেউ এই ঋণ বের করছে কিনা; বিশেষ পরিদর্শনের মাধ্যমে যাচাই করা দরকার। এর পরও নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে তিন হাজার ২১৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
মতামত জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মনসুর সমকালকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক এক সময় খুব ভালো ব্যাংক ছিল। মালিকানা পরিবর্তনের পর এর অবস্থা দুর্বল হতে শুরু করে। ব্যাংকটিতে গত কয়েক বছরে প্রচুর অনিয়ম ঘটেছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় আগে থেকেই অনিয়মের বিভিন্ন ঘটনা জেনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন তদন্ত দল গঠন করেছে। কিন্তু আগে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়া ব্যর্থতা। ফলে এসব অনিয়মের দায়ও এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, দেশের এক নম্বর রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক আগে অন্য ব্যাংকে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে পারত। এখন নিজের গ্রাহকদের আমদানি দায় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এক পরিবারকে বিশেষ সুবিধা দিতেই তাদের এ করুণ পরিণতি। আহসান এইচ. মনসুর মনে করেন, ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যেভাবে টাকা বের হয়ে গেছে, তার সঠিক তদন্ত হতে হবে এবং ফলাফল জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। এ দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাঁর মতে, দ্রুত ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দেওয়া উচিত। ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায়ে যারা অনিয়মে সম্পৃক্ত, তাদের চাকরিচ্যুত করা উচিত। একই সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঋণ বেড়েছে দ্রুত :২০১৭ সালে মালিকানা বদল হলেও প্রথম দুই বছর ইসলামী ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল স্বাভাবিক। তবে ২০২০ সালের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্রত্যাহারের পর দ্রুত তা বাড়তে থাকে। চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসেই ব্যাংকটিতে ২৫ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা ঋণ বেড়ে এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা বেড়ে হয় এক লাখ ১৯ হাজার ১১৭ কোটি। ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ তিন হাজার ৫২৯ কোটি টাকা হয়। এর আগে ২০১৯ সালে বেড়েছিল ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে বেড়েছিল ৯ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। এর আগের বছরগুলোতে ব্যাংকটির ঋণ বৃদ্ধি আরও কম ছিল।