রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় রেকর্ড গড়েছে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। ফলে আমদানিতে লাগাম টানে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানির এলসি খোলায় বিভিন্ন শর্তও আরোপ করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্নমুখী তৎপরতায় আমদানি কিছুটা কমে এলেও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়নি। উল্টো দিন যত যাচ্ছে, সংকটও তত বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ যেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। চলমান ডলার সংকটের কারণে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকই নতুন করে খুলছে না তাদের ফি পাঠানো-সংক্রান্ত প্রোফাইল। এতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডলার পাঠাতে না পারায় অনেকেরই ভর্তি বাতিল হয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। এতে শিক্ষার জন্য বিদেশ গমনেচ্ছুদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করা একাধিক শিক্ষার্থী জানান, স্টুডেন্ট প্রোফাইল খোলার জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারা যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কেউই রাজি হয়নি। এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে তাদের অনেকে নানা মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে স্টুডেট ফাইল খোলা বন্ধ রাখা হয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক সীমিত পরিসরে চালু রাখলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে মলডোবায় থাকা শিক্ষার্থী আনন্দ রয় বলেন, এটা একেক দেশের একেক নিয়ম। মলডোবায় স্টুডেন্ট প্রোফাইল ছাড়া শিক্ষার্থী আসতেই পারবে না।
এমনকি যৌথ অ্যাকাউন্ট বা অন্য কারও মাধ্যমে অর্থ দেখানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, জানুয়ারিতে নতুন সেমিস্টারের জন্য পরিচিত কিছু ছোট ভাই স্টুডেন্ট প্রোফাইলের জন্য ঘুরছে। কিন্তু প্রোফাইল তৈরি করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে ভর্তি বাতিলও হয়ে যেতে পারে। একই কথা বলেন, নরওয়েতে থাকা শিক্ষার্থী আদ্রিতা তাবাস্সুম। তিনি বলেন, এখন নরওয়েতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আসার উৎকৃষ্ট সময়। কোনো রকম আইইএলটিএস স্কোর ভালো থাকলেই আসা যাবে। আর এনশিওর করতে হবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চ্যানেলে, যা হবে প্রোপার চ্যানেলে।
আবার অ্যাকাউন্টে দেখানো অর্থ নরওয়েতে এসে খরচও করতে পারবেন। তবে স্টুডেন্ট প্রোফাইল ছাড়া এদেশে আসা সম্ভব না। সূত্র জানায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা মূলত দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ভর্তি, টিউশন, আবাসন ফিসহ বিভিন্ন খরচ পাঠান। এজন্য ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের একটি ফাইল খুলতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয়, ব্যাংকগুলোর এমন সব এডি শাখা থেকেই ফাইল খোলার সুযোগ রয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ওই ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঠান। সম্প্রতি ইংল্যান্ডে মাস্টার্সের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন আদিব চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার স্টুডেন্ট প্রোফাইল খোলা হয়েছে আগস্টে। কিন্তু এরপর থেকে আমার অনেক পরিচিত সম্প্রতি স্টুডেন্ট প্রোফাইল খুলতে পারছে না।
ইংল্যান্ডে আসতে ব্যক্তি নামেই প্রোফাইল থাকতে হবে। আমার প্রোফাইলটা আগেই খুলে রেখেছিলাম না হলে হয়তো এডমিশন বাতিল হয়ে যেতো। আমার এক বন্ধু প্রোফাইলের জন্য ইংল্যান্ডে আসতে পারেনি। পরে অবশ্য প্রোফাইল ছাড়াই ভিয়েতনামে এডমিশন হয়েছে। ইতালিতে গিয়েছেন নীলজৃত রকি। তিনি বলেন, আমি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। এরপর ব্যাংক প্রোফাইল ছাড়াই আবেদন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা পাঠানোর জন্য আমার এক পরিচিত ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়। ওই অ্যাকাউন্টেই ফিক্সড ব্যালেন্স শো করি। ওই ভাই আমার হয়ে টাকা জমা দেয় এবং আমি পেপারস জমা দেই। আমার জানা মতে এভাবে সকলে আসতে পারে না।
এটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ চ্যানেল। রোমানিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মিরাজ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি শতভাগ স্কলারশিপে পড়তে যাচ্ছি। ফলে প্রোফাইলের প্রয়োজন হয়নি। তবে অ্যাম্বাসিতে একটা যৌথ পরিচিত ভাইয়ের প্রোফাইল দেখিয়েছি। সূত্র জানায়, দেশের বেসরকারি ও বিদেশি প্রথম সারির ব্যাংকগুলো বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল খোলে। তবে ডলার সংকটের কারণে সম্প্রতি বেশির ভাগ ব্যাংকই এসব ফাইল খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু ব্যাংক এখনো চালু রাখলেও প্রভাবশালীদের তদবির লাগছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের জন্য গত বছর ৫ হাজার ৩৯০টি ফাইল খুলেছিল বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক।
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকটি খুলেছে ৭ হাজার ৮৪০টি নতুন ফাইল। তবে গত মাসের শেষের দিক থেকে নতুন ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছে তারা। সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, দেশে এখন ডলারের তীব্র সংকট চলছে। এ কারণে আমরা আপাতত নতুন ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছি। বিদ্যমান বা পুরনো যেসব ফাইল খোলা হয়েছিল, সেগুলো সচল রাখা হয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়েছেন উচ্চশিক্ষা নিতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো ডলারের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা ১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩২ কোটি ১০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বাবদ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।