পাল্টাপাল্টি দাবিতে রাজধানীতে একইদিনে সমাবেশের আয়োজন করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী জুমার নামাজের পরই আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা। এরইমধ্যে উভয় দলের নেতাকর্মীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে জড়ো হয়েছেন সমাবেশস্থলে। দিচ্ছেন বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করে বিভিন্ন স্লোগান। এতে সময়ের সাথে সাথে উত্তেজনার পারদ আরও বাড়ছে।
কয়েকদিনের নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে পছন্দের জায়গায় সমাবেশের অনুমতি পায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের তিন অঙ্গ সংগঠন। উভয়ই চায় যে কোনো মূল্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে। সে লক্ষ্যে একদিন পিছিয়ে নিজেদের ঘরের মাঠ নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করছে বিএনপি। তাদের মোকাবিলায় বায়তুল মোকাররমে ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ শিরোনামে পাল্টা সমাবেশের আয়োজন ক্ষমতাসীন দলের তিন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের। ইতোমধ্যে সমাবেশের সকল প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে উভয় দলই।
নয়াপল্টন জনসমুদ্র
সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ শুরু হতে এখনও কিছুটা সময় বাকি আছে। কিন্তু বেলা ১২টার মধ্যেই সমাবেশস্থলসহ আশপাশের এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। দুপুর দুইটায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সমাবেশ শুরুর কথা।
সকালেই অফিসের সামনে ৯টি বড় ট্রাক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বেঁধে দেয়া সীমানায় ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইলসহ আশপাশে টাঙানো হয়েছে দেড় শতাধিক মাইক। মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ইতোমধ্যে নয়াপল্টনের সমাবেশস্থলে তিনি উপস্থিত হয়েছেন।
মহাসমাবেশ ঘিরে সকাল থেকেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে খণ্ড খণ্ড মিছিলে জড়ো হতে শুরু করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। গায়ে রঙিন পোশাক, হাতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, পতাকা নিয়ে বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেনে তারা। বর্তমানে যারা সমাবেশস্থলে আছেন তাদের অনেকেই গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেই এসে হাজির হয়েছেন। রাতভর নয়াপল্টনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন। তারা বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মী।
বর্তমানে কাকরাইল মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় হয়ে নয়াপল্টনের সামনের সড়ক হয়ে আরামবাগ পর্যন্ত পুরো সড়ক বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলে চলে গেছে। অন্যদিকে মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, বিজয়নগরসহ আশপাশের অলিগলিতেও অবস্থান নিয়েছেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। তবে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, পথে পথে তাদের হয়রানি করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের নামে করেছে হেনস্তা। মানুষের ভিড় ও চাপ বাড়তে থাকায় সকাল থেকে নয়াপল্টনের দুই পাশের সড়কই যান চলাচল পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে।
আসতে পারে নতুন ঘোষণা
এদিকে বিএনপির আজকের মহাসমাবেশ থেকে আসতে পারে আন্দোলনের গতি পাল্টানোর ঘোষণা। যার পুরোটা হবে ঢাকা ঘিরে। এরমধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে একই দিনে সভা-সমাবেশের বিষয়টি আছে আলোচনার শীর্ষে। তাৎক্ষণিকভাবে রাজপথে টানা অবস্থানসহ কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সমাবেশে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে পালটে যেতে পারে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করবে জনগণ। সরকারের পদত্যাগের জন্য এবার সময় বেঁধে দেয়া হবে। ঢাকার সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি আসলে সবাইকে একযোগে রাজপথে নামতেও আহ্বান জানান বিএনপির এই নেতা।
জড়ো হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও
বিএনপি-জামায়াতের হত্যা, ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে আয়োজিত শান্তি সমাবেশ বিকেল ৩টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় জড়ো হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের আয়োজনে ঢাকা বিভাগীয় শান্তির সমাবেশের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সকাল থেকে ঢাকার বাইরে থেকে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা এসেছেন সমাবেশস্থলে। বর্তমানে মঞ্চের চারপাশে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপির নানা অপকর্ম তুলে ধরে স্লোগান দিচ্ছেন।আজকের শান্তি সমাবেশে ক্ষমতাসীনরাও দেখাতে চায় তাদের জনসমর্থন। দুই লাখ লোকের জমায়েত করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। এজন্য ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও মহাসমাবেশে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা বলছেন, তরুণদের নির্বাচনমুখী করার পাশাপাশি বিএনপির সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জাগরণ সৃষ্টির বার্তা আসবে সমাবেশ থেকে। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতা থেকে সতর্ক থাকতে ও যেকোনো সহিংসতা প্রতিরোধে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সতর্ক পাহারায় থাকার নির্দেশ দেয়া আছে ক্ষমতাসীনদের। শান্তি সমাবেশ সভাপতিত্ব করবেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলের শামস পরশ। সমাবেশটি সঞ্চালনা করবেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
সংঘাত হতে পারে যেখান থেকে
অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচি থেকে বহু সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেদিক থেকে আজকের সমাবেশের স্থান খুবই কাছাকাছি। দূরত্বের হিসেবে মাত্র দুই কিলোমিটারেরও কম। ফলে এতো অল্প দূরত্বে থেকেও বিশাল জনসমাগম থেকে সংঘাত হবে না- এটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না।
অতীতে দেখা গেছে, সংঘাত বা সংঘর্ষ শুরু হয় আশপাশ থেকে। সে হিসেবে আজকে বিজয়নগর ও ফকিরাপুল এলাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। আর ওই এলাকা থেকে দৈনিক বাংলা মোড় ও পল্টন হয়ে বায়তুল মোকাররম এবং গুলিস্তান এলাকার সংযোগ রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়লে তারাও যেতে পারে সেদিকে। এজন্য বেশ সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রস্তুত পুলিশ
দুই কিলোমিটারের কম দূরত্বের দুই সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বেলা যত বাড়ছে পুলিশের জনবলও আসছে। তবে গুলিস্তান এলাকা থেকে নয়াপল্টনের দিকে বেশি নজর পুলিশ প্রশাসনের। সেখানে প্রস্তুত রাখা হয়েছে পুলিশের আর্মড ভেহিক্যাল, এসকর্ট ভেহিক্যাল, সাঁজোয়া যান এপিসি ও জলকামান।
অলিগলিতে সাদা পোশাকে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি। ঢাকায় প্রবেশমুখের সবকটি পয়েন্টে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। যানবাহনে চলছে ব্যাপক তল্লাশি। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, দুই দলের সমাবেশকে ঘিরে অন্তত ৩০ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। র্যাব, আনসার, এপিবিএনের অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য প্রস্তুত আছে। যাদের প্রায় সবার নজর থাকবে বিএনপির সমাবেশের দিকে। সেখানে কোন ধরণের সংঘাতের খবর পেলেই অ্যাকশনে যাবে পুলিশ। এ ছাড়া বিজিবি থাকবে স্ট্যান্ডবাই। বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা মাঠে নামবে। গোয়েন্দা সংস্থা, আনসার, বিজিবি, র্যাব ও ঢাকা হাইওয়ে রেঞ্জের কর্মকর্তারা কন্ট্রোল রুমে বসে দুই সমাবেশে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখবেন।
আজ আরও যাদের কর্মসূচি
বিএনপি, আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি রয়েছে আজ। এরমধ্যে সকাল ১০টা থেকে পুরানা পল্টনে সমাবেশ করেছে ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। আর বিজয়নগর আল রাজি কমপ্লেক্সের সামনে ১১টা থেকে জাতীয়তাবাদী সম্মাননা জোটের কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিজয়নগর বিজয় ৭১ চত্বরে এবি পার্টি, মৎস্যভবনের সামনে সড়কে বিকেল ৩টায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজয়নগর পানির ট্যাংকের সামনে বিকেল ৩টায় ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিকেল ৪টায় গণধিকার পরিষদ (কিবরিয়া-ফারুক), পল্টনে প্রীতম জামান টাওয়ার সামনে বিকেল ৩টায় গণঅধিকার পরিষদ (নুরু-রাশেদ), মতিঝিলের নটরডেম কলেজের উল্টোপাশে বিকেলে গণফোরাম ও পিপলস পার্টির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।