দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাত্ করে অনেক বেড়ে গেছে। গত আগস্টে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাত্, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উত্পাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক বৈঠকে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা অর্থাৎ এক হালি ৪৮ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। কিন্তু দর বেঁধে দেওয়ার পরের দিন গতকাল বাজারে গিয়ে নির্ধারিত দরে কোনো পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়নি।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিন রাজধানীর খুচরা বাজার মনিটরিং করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে। গতকাল সেই প্রতিবেদনেও তারা এসব পণ্য বেশি দামে বিক্রির তথ্য তুলে ধরে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, গতকাল বাজারে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি হালি ৫০ থেকে ৫৩ টাকা, আলু ৪৩ থেকে ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল রংপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সে জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা নতুন দাম ঘোষণার পর গত বৃহস্পতিবারই তা সব জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানিয়েছে।
বেঁধে দেওয়া দর প্রসঙ্গে তুরাগ এলাকার নতুন বাজারের এক বিক্রেতা বলেন, সরকার যে ডিম, আলু, পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে তাতো আমরা জানি না। সেই বিক্রেতাকে বেঁধে দেওয়া দরের কথা জানালে তিনি বলেন, এই দরে কীভাবে বিক্রি করব? পাইকারি বাজারে, আড়তে এসব পণ্যের দাম বেশি। সেখানে দাম না কমলে খুচরা বাজারে কীভাবে কমবে? একই কথা জানালেন, কাওরান বাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আড়ত থেকে যে দরে ডিম কিনি তাতে প্রতি হালিতে সামান্য মুনাফায় বিক্রি করি। তাহলে সরকার যে দর নির্ধারণ করেছে সে দরে কীভাবে বিক্রি করব?
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মো. মোহসিন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, দেশে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের দিকে সবজির দাম একটু বেশি থাকে, যে কারণে ডিমের দাম বাড়ে। তবে সরকার ডিমের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে দরে আমরা ডিম বিক্রি করতে পারব যদি আমাদের শুধু ডিম বিক্রি করার জন্য সরকার একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়। তাহলে ডিম বেশি হাতবদল হবে না। এতে খরচ কমবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি ডিমের উত্পাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা হলে খুচরা বাজারে তা ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ হিসেবে এক হালি ডিমের দাম হয় ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় ছয় কোম্পানি ও চার বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। একই অবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও। বেশি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেছেন, যেসব ব্যবসায়ী আলু সংরক্ষণ করেছেন, তারা দাম বাড়াচ্ছেন। খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৬ টাকা কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, বাজার তদারকিতে সরকারের গাফিলতি আছে। তদারকির নামে সরকারি কর্মকর্তারা ফোন করে আলুর বাজারের তথ্য নিচ্ছেন, সরাসরি বাজারে গিয়ে খোঁজ নেন না। বিশেষ করে হিমাগারগুলোতে সরাসরি তদারকি না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পণ্য তিনটির নির্ধারিত দর বাস্তবায়নে খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে তখনই বেশি সুফল পাওয়া যাবে যখন পাইকারিবাজার, আড়তদারদের ধরা হবে। সেখানে কঠোর অভিযান না চালালে নির্ধারিত দর বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। কারণ, এর আগে সয়াবিন ও চিনির দর বেঁধে দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও অনেক সময়ই সরকারের পক্ষে সারা দেশে তদারকি করা সম্ভব হয় না। এজন্য দর বেঁধে দিয়েও অনেক সময়ই কোনো লাভ হয় না’। তিনি বলেন, ‘এখন তো আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম কমছে। এছাড়া যে পণ্যগুলোর দর বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা সবই এদেশের পণ্য। এসব পণ্যের দাম তো এত বেশি বাড়ার কথা নয়। এখানে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেট সরকারকে ভাঙতে হবে। একই সঙ্গে ভোক্তারা যদি এ বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে যে—আমি কিছুদিন পেঁয়াজ খাব না বা ডিম খাব না।—যেটা অনেক দেশেই নয়। এ রকম হলে পণ্য নিয়ে কারসাজি কম হবে।’