বালিশ খেলা থেকে বাদ পড়া ওই নারী ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় থাকা ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মোমিনুর ইসলাম সাইমের মা। আর মোমিনুর নিজেই যখন মাইকে বলে উঠে, ‘এবার বাদ পড়লেন মোমিনের মা।’ তখন সেখানে হাসির রোল পড়ে যায়।
মোমিন ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দিনভর ধারাভাষ্য দিচ্ছিল সেরিব্রাল পালসি (সিপি) আক্রান্ত এই শিশুটি। তার ধারাভাষ্যে ক্ষণে ক্ষণেই ছুটছিল হাসির ফোয়ারা। নিজেসহ সবাইকে হাসিয়েছে তার ধারাভাষ্য।
শুধু মোমিনের ধারাভাষ্যই নয়, বিস্কুট দৌড় প্রতিযোগিতায় এসে সবার প্রথম বিস্কুট মুখে ধরতে পারলেও না দৌড়ে দাঁড়িয়ে সেটি খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে যায় হাবিব নামে আরেক শিক্ষার্থী। আগত অতিথিরা অবাক। সবাই তাকে বলছে, বিস্কুট মুখে দৌড়ে প্রান্তসীমায় যেতে, প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার সুযোগ থাকলেও না দৌড়ে শেষমেশ আরও কয়েকটি বিস্কুট খেয়ে সবার শেষে ফেরে সে। আর তাকে বিস্কুট খেতে সহযোগিতা করে আয়োজকদেরই একজন।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) মানিকগঞ্জের আটিগ্রাম ইউনিয়নের বাসাই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী ও আলোচনা অনুষ্ঠানে দিনভর এমন বহু কাণ্ড ঘটে।
এদিন স্কুলটির শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় নানা প্রতিযোগিতায়। দিনের শুরুতেই কুচকাওয়াজ, দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিকতা। এরপর বিস্কুট দৌড়, ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ, দীর্ঘ লাফ, মিউজিক্যাল চেয়ার-বালিশ খেলাসহ মোট সাতটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া অভিভাবক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা হাড়ি ভাঙা ও বালিশ নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের এসব খেলা দেখতে স্কুলটিতে উপস্থিত হন স্থানীয় সাধারণ মানুষও। খেলায় ঘটে যাওয়া নানা কাণ্ড আনন্দ যোগায় উপস্থিত সব বয়সীদের মধ্যে। কখনও কখনও হাসিতে ফেটে পড়েন সবাই।
তবে এতসব হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক রাশ বেদনার গল্প। যা উঠে আসে পুরস্কার বিতরণী শেষে হওয়া আলোচনা অনুষ্ঠানে। এ সময় বক্তারা জানান, স্থানীয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদ্যালয়টি। বর্তমানে এতে শিক্ষা ও চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় অর্ধ শতাধিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। তবে বিদ্যালয়টি পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে বলে জানান বক্তারা। বিদ্যালয়টির শিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার জন্য সমাজের বিত্তবাদনদের এগিয়ে আসতে আহ্বান জানানো হয়।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, বিদ্যালয়টিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত যাতায়াত, দুপুরের খাবার, চিকিৎসার জন্য পেশাদার থেরাপিস্ট দিয়ে থেরাপি দেওয়া, খেলাধুলাসহ নানা সেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করা হয়। সমাজের সচেতন ও মানবিক কিছু মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় চলছে এ কার্যক্রম। তবে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সেই সহযোগিতা কমে আসায় বিদ্যালয় পরিচালনায় সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের সদস্য সচিব শামসুজ্জামান শামস বলেন, ১৩ বছর আগে আমার ভাই পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানের ঘটনায় জিম্মিদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে শহীদ হন তিনি। এরপর থেকেই আর্থিক সঙ্কটসহ নানা সঙ্কটে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থীদের দেওয়া নানা সেবা সচল রাখা ও নতুন সেবা চালু করা যাচ্ছে না। স্কুলটিতে বর্তমানে ৪৬ জন ছেলে-মেয়ে অধ্যায়নরত। বিদ্যালয়টি পরিচালনায় সহযোগিতায় সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
দিনের শেষে পুরস্কার বিতরণ, খাবার বিতরণ ও শীতবস্ত্র বিতরণের মধ্য দিয়ে ইতি টানা হয় এ আয়োজনের।