রোজা শুরুর পর থেকে পথে নামলেই যানজটের এই নিত্য দুর্ভোগে ত্যক্ত-বিরক্ত রাজধানীবাসী। শান্তিনগর উড়ালসড়কে বিআরটিসির দোতলা বাসের দোতলায় আফসোস নিয়ে বসে ছিলেন হারুন মিয়া। ওই উঁচু থেকে উঁকি দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে তাঁর সমস্যা হচ্ছিল না। যত দূর চোখ যায় যানজট আর যানজট। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টায় গুলিস্তান থেকে ওই বাসে চড়ে বারিধারায় পৌঁছেছিলেন বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা হারুন মিয়া হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘রোজা রেখে এই বিকেলে রোদের মধ্যে আর হাঁটার শক্তি নেই। বাস যখন যায় যাক। পাপ না করলে কেউ বুঝি এই শহরে থাকে! এক ঘণ্টার পথ যেতে হচ্ছে চার ঘণ্টায়। এসব ভাবলে মেজাজ ঠিক রাখা অসম্ভব। সেই ভালো, মেনে নাও। মেজাজটা আর বিগড়াবে না!’
হাতিরঝিল থেকে মোটরসাইকেলে পান্থপথ পর্যন্ত আসতে ২৫ মিনিট লেগেছে বেলায়েত হোসেনের। তাঁর ভাষ্য, যাঁরা বাসে বসে আছেন, তাঁরা এইটুকু পথ ৫০ মিনিটেও আসতে পারবেন না। অথচ এটা ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। যানজটের এই ভোগান্তি মেনে নিয়েই সড়কে বের হতে হবে।
হারুন-বেলায়েতের মতো অবস্থা রাজধানীর সড়কে চলা লাখ লাখ মানুষের। সবাই যানজটে ভোগান্তির শিকার। যানজটের পেছনে অনেক কারণ একসঙ্গে কাজ করে। ঢাকার সড়কে চলে অব্যাহত খোঁড়াখুঁড়ি। এতে রাস্তায় তৈরি হয় জটলার। রয়েছে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা। বেড়েছে ছোট যান চলাচল। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি বেড়েছে মোটরসাইকেল।
দুই বছরে মোটরসাইকেল-ইজি বাইক বেড়েছে ৩০ লাখ
রাজধানীতে মানুষের বসবাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। সেই তুলনায় বাড়েনি সড়ক। এই অবস্থায় ছোট যান নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে যানজট কমানো সম্ভব নয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শুধু মুখে কথা বলছি, কাগজে কোনো সমাধান নিচ্ছি না। মুখে কথা বলে যানজটের মতো সমস্যার সমাধান হবে না। যানজট একটা বৈজ্ঞানিক বিষয়। বৈজ্ঞানিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। করোনার দুই বছরে গণপরিবহন সীমিত থাকায় জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। ২০২০-২১ সালে ১০ লাখ নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন করা হয়েছে, যা যানজটের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ’
বিশৃঙ্খল সড়ক যানজটের অন্যতম কারণ
রাজধানীর যানজটের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ সড়কে বিশৃঙ্খলা। আবার সড়কের বিশৃঙ্খলার পেছনে দায়ী গণপরিবহন। গণপরিবহনে নেই দক্ষ পেশাদার চালক। ফলে এসব অপেশাদার চালকের কাছে সড়কে শৃঙ্খলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় কত বেশি যাত্রী তোলা যায় তার বাসে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের প্রধান মুনিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সড়কে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করা হচ্ছে।
‘চেইন সিস্টেমে’ যানজটের প্রভাব ছড়ায়
রাজধানীর বড় সংযোগ সড়কগুলোয় যানজট সৃষ্টি হয়ে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে পাশের অন্য সড়কে। বিজয় সরণি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। এই বিজয় সরণির সঙ্গে মহাখালী, বনানী, তেজগাঁও সাতরাস্তা, তেজগাঁও লিংক রোড, ফার্মগেট, খামারবাড়ি ও আগারগাঁও এলাকা সরাসরি যুক্ত। বিজয় সরণির যানজটের প্রভাব এই পুরো এলাকায় পড়ে।
আবার ফার্মগেটের যানজট গিয়ে ঠেকে কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও মগবাজার এলাকায়। বনানীর যানজট যায় বিমানবন্দর পর্যন্ত। খামারবাড়ির যানজট আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রোড পর্যন্ত ছড়ায়। মগবাজারের যানজটের প্রভাব মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা হয়ে বাড্ডা পর্যন্ত চলে আসে। এভাবে ঢাকার যানজট চেইন সিস্টেমের মধ্যে দ্রুত ছড়ায়।
যানজট ছড়ানোর জন্য বিজয় সরণি, বনানী, মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা, গুলিস্তান, বিমানবন্দর, কারওয়ান বাজার, মিরপুর রোড, মিরপুর-১, সায়েন্সল্যাব, পান্থপথ, মগবাজার এলাকা যথেষ্ট। এসব এলাকায় যানজট তীব্র হলে তা দ্রুত পুরো রাজধানীতে প্রভাব ফেলে। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীতে বিকল্প সড়কব্যবস্থা খুব কম। ফলে নির্দিষ্ট কিছু রাস্তা ছাড়া গন্তব্যে যাওয়ার উপায় নেই। রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ দিকে চলাচলের জন্য যে কয়টি পথ রয়েছে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমে চলাচলের জন্য তেমন পথ নেই। ’
উন্নয়নকাজে বাড়ছে যানজটের ভোগান্তি
দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকাজে যানজটের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে। এক বাস র্যাপিট ট্রানজিট (বিআরটি-৩) নির্মাণকাজে বছরের পর বছর যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরগামী মানুষকে। মেট্রো রেল নির্মাণ এলাকায় নিচের পথ ছোট হয়ে এসেছে। এ অবস্থায় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে পাশাপাশি একটির বেশি বাস যাতায়াত করতে পারে না। একই অবস্থা রাজধানীর বহু সড়কে। সঙ্গে সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি তো আছেই।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘অনেক সমস্যার সমষ্টিগত ফল যানজট। উন্নয়নকাজের ধীরগতিও যানজটের জন্য দায়ী। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। একটা রাস্তা মেট্রো রেলের কাজের জন্য অর্ধেক দখল হয়ে থাকলে এর প্রভাব পেছনের সড়কে পড়বেই। পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভাব রয়েছে আমাদের। ’