কোনো প্রবাসী দেশে ফোন করলে দেশেরই কোনো নাম্বার থেকে সেই কল আসত। যদিও দেশের বাইরে বাংলাদেশের নাম্বার ব্যবহার হওয়ার কথা না। এই প্রক্রিয়াটি ঘটতো একটি মেশিনের মাধ্যমে। যার নাম ভিওআইপি বা ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল। বৈধ কলের একটি অংশ অবৈধ ভিওআইপি কলে পরিণত হওয়ায় একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাতো, অন্যদিকে আইজিডব্লিউ অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আয় কমে যেত। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বন্ধ করা যায়নি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। কিন্তু মোবাইলের কলরেট বৃদ্ধি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে কয়েক বছর আগের রমরমা এই ব্যবসা অনেকটাই কমে গেছে। অনেকের মতে, এই ব্যবসা এখন বিলুপ্তির পথে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভিওআইপি ব্যবসা ছিল রমরমা। বিশেষ করে থ্রিজি-ফোরজি নেটওয়ার্ক চালুর আগে এই ব্যবসা ছিল জমজমাট। ২০১৬ সালের পর থেকে এই ব্যবসায় ভাটা পড়ে। বর্তমানে ইন্টারনেটে স্কাইপ, ভাইবার, গুগল টক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে অডিও বা ভিডিওতে কথা বলার সুযোগ থাকায় ভিওআইপি ব্যবসার বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
একজন ভিওআইপির আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন, যিনি এই ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন। নামপরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ‘ভিওআইপি মেশিন দেখতে কম্পিউটারের সিপিইউ’র (সেন্ট্রাল প্রোসেসিং ইউনিট) মতো। সিপিইউতে যেমন ডিভিডি রোম থাকে। মেশিনে থাকে মোবাইলের সিম বসানোর জায়গা। কোনো মেশিনে ৬টি, কোনোটিতে ৮টি, কোনোটিতে ১২টি, কোনোটিতে ২৪টি, কোনোটিতে ৩৬টি, কোনো মেশিনে ৪৮টি সিম কার্ড একসঙ্গে সচল রাখা যায়। একটি মেশিনে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৭২টি মোবাইল সিম কার্ড সচল করার ব্যবস্থা আছে। সিম অনুযায়ী মেশিনের দাম নির্ধারণ হয়। ছয় সিমের মেশিনের দাম ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। ৭২ সিমের মেশিনের দাম ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব মেশিন মূলত ইসরায়েলের তৈরি, যা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া হয়ে বাংলাদেশে আসত।
ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিমকার্ড কীভাবে পেতেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সিমকার্ড দেওয়ার জন্য সাপ্লাইয়ার ছিল, যারা সিম বিক্রি করে তারাই দিয়ে যেত। অন্যান্য কোম্পানির সিম ডিভাইজে চালুর ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর কোম্পানি সিম বন্ধ করে দিত। সেদিক থেকে ভালো ছিল টেলিটক। সিম কাটতে অনেক সময় লাগত। তাই সবাই টেলিটক ব্যবহার করত।’
ব্যবসা মন্দা হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে দেশের বাইরে থেকে প্রচুর কল আসত। তাতে ব্যবসায়ীদের অনেক লাভ হতো। এখন আর তেমন অবস্থা নেই। সব কল আসে ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এছাড়া সিমের দামও বেশি। সিমকার্ড পাওয়া কঠিন। আর সব ম্যানেজ করলেও কল আসে খুব কম। যার ফলে এখন লাভ তেমনটা হয় না। একসময় ভিওআইপি ব্যবসা করে যারা লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন, এখন তাদের অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়েছেন। এখনও যারা ব্যবসা করেন, তাদের তো খরচই ওঠার কথা না।’
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আমার সময় যারা ব্যবসা করত, তারা এখন ব্যবসা বাদ দিয়েছে৷ মেশিন সব গ্রামে নিয়ে গেছে। কারও মেশিন খাটের নিচে, কারও বাতিল মালামালের সঙ্গে পড়ে আছে। এটা তো বাইরে বিক্রি করার সুযোগও নাই।’
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভিওআইপি দেশের রাজস্বের ক্ষতি করে। যে রাজস্ব সরকারের পাওয়ার কথা, এটা মাঝখানের তৃতীয় পক্ষের পকেটে চলে যায়। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। ফলে ভিওআইপিকে সরকার কোনোভাবেই সমর্থন করে না। তাই এর যত উৎস ছিল তা বিটিআরসির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা জব্বার বলেন, ভিওআইপি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে কি না বলতে পারব না। তবে আগে যে অবস্থায় ছিল, এখন সে অবস্থায় নাই এটা বলতে পারি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এর প্রধান তীর ছিল টেলিটকের দিকে। আমরা টেলিটকের দিকে যত্নশীল হয়েছি।’