গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের শিল্প খাত। দাম কমে গেলেও ডলার সংকট ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত না থাকায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজির) আমদানির এলসি খুলতে পারছে না পেট্রোবাংলা। প্রতিষ্ঠানটি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করবে। এরপর এর দাম আরও কমলে আমদানির জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ পাঠাবে। অথচ শিল্প-কলকারখানার মালিকরা প্রয়োজনে বাড়তি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন সরকারকে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি নীতিনির্ধারকরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে গেছে। সেই গ্যাস ক্রয়ের বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই কোথাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পে গ্যাস সংকট মেটাতে স্পট মার্কেট থেকে উচ্চ দরে জ্বালানি আমদানির নির্দেশ দিলেও গত ১৪ দিনেও সেটি কার্যকর হয়নি। ৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে জ্বালানি বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ক্রমবর্ধমানভাবে কমে যাচ্ছে, এটি একটি ভালো খবর। তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। আগামী ডিসেম্বরেও তারা স্পট মার্কেট পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর সহনীয় ও যৌক্তিক পর্যায়ে এলে বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে। তারপর সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সে অনুযায়ী কাজ করবেন তারা। কারণ হিসাবে তার যুক্তি ডিসেম্বর মাসে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। কারণ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে গড়ে ৩টি করে এলএনজিবাহী কার্গো এলেও ডিসেম্বরে আসবে ৪টি। তাতে কমপক্ষে ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস বেশি অতিরিক্ত যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। এছাড়া বিবিয়ানার একটি কূপ সংস্কার কাজ শেষ হবে ডিসেম্বরের শুরুতে। তাতে ৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস অতিরিক্ত আসবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ১৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস অতিরিক্ত পাব। ফলে শিল্পের সংকট কমবে।
শিল্প খাতের নেতারা বলেছেন, বর্তমানে গ্যাসের যে তীব্র সংকট চলছে মোট কর্মসময়ের ৪০-৪৫ শতাংশও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। শ্রমিকদের বসিয়েই বেতন দিতে হচ্ছে। গত এক বছরে উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। হাজার হাজার শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের মোট শিল্প-কারখানার প্রায় ৭০ ভাগই এখন হুমকির মুখে। বেকার হয়ে গেছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। বিশ্বমন্দার মধ্যে রপ্তানি আয় ধরে রাখার পরিকল্পনা জ্বালানি সংকটের কারণে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে চীন-ভারত-ভিয়েতনাম। উদ্যোক্তারা বলেছেন, এ অবস্থা আর এক মাস চললে শিল্পে বড় বিপর্যয় ঘটবে। বন্ধ করে দিতে হবে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। তাতে কর্মসংস্থান হারাবে আরও অসংখ্য মানুষ। নতুন বিনিয়োগ নয়, উৎপাদন বিপর্যয় ঠেকানো নিয়েই মালিকরা এখন শঙ্কিত।
জানা গেছে, স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম এখন গত ৭ মাসে সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে গত আড়াই মাসে জ্বালানি পণ্যটির দাম কমেছে ৬৫ শতাংশের বেশি। বাজারে এখন প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট জ্বালানি পণ্য পরিমাপের একক) এলএনজির দাম নেমে এসেছে ২৫ ডলার ৮৮ সেন্টে। প্রতিদিনই দাম কমছে। আগামী মাস নাগাদ পণ্যটির দাম আরও কমে আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের পর্যবেক্ষকরা। অথচ শিল্প-কারখানার চরম এই দুর্দিনে এখনই স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি ক্রয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই পেট্রোবাংলার। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম এখন কমতির দিকে থাকলেও তা কিনছে না পেট্রোবাংলা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে আনা এলএনজির মূল্য পরিশোধ নিয়েই তাদের এখন মূল চিন্তা। আগামী কয়েক মাস ধরে এসব দেনা শোধ করতে হবে। ফলে এখন আমদানি করলে দেনা আরও বাড়বে। এ অবস্থায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া এখনই স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারবে না বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলার শীর্ষ স্থানীয়রা।
যদিও পেট্রোবাংলার এই বক্তব্য মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য এলএনজি কিনতে যে ডলারের প্রয়োজন সেটা দেবে ব্যাংক। পেট্রোবাংলাকে টাকা দিতে হবে না। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পেটোবাংলা ওপরের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। ওপর থেকে নির্দেশ পেলেই তারা এলএনজি আমদানির এলসি খোলার উদ্যোগ নেবেন। তবে প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন এলএনজি আমদানি সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। এটি জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করা উচিত বলে উদ্যোক্তারা মনে করেন। তাদের মতে, দাম কমে যাওয়ায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এলএনজি কিনে রিজার্ভ করে রাখছে।
সর্বশেষ গত মে মাসে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনেছিল পেট্রোবাংলা। সে সময় প্রতি এমএমবিটিইউ কিনতে ব্যয় হয়েছিল ২৬ ডলার ৪ সেন্ট। ওই সময় এ দরে সিঙ্গাপুরের ভিটল এনার্জির কাছ থেকে এক কার্গো এলএনজি কিনতে পেট্রোবাংলার ব্যয় হয়েছিল ৯০৯ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরপর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ কমে যায় ১৫০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
স্পটের মতো ফিউচার মার্কেটেও এখন এলএনজির দাম কমতির দিকে। উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় ডিসেম্বরে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম এখন নেমে এসেছে ২৬ ডলারে। এক সপ্তাহের এ চুক্তির আওতায় এলএনজির দাম কমেছে প্রতি এমএমবিটিইউতে ২ ডলার বা ৭ শতাংশ। এছাড়া ডিসেম্বরে সরবরাহ চুক্তিতেই ইউরোপমুখী কার্গোয় পরিবাহিত এলএনজিতে এমএমবিটিইউ প্রতি ১১ ডলার কমিশন দিয়ে বেচাকেনা হচ্ছে ২১ ডলারে।
চলতি বছরের ২৫ আগস্ট বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি এমএমবিটিইউ ৬৯ ডলার ৯৬ সেন্ট। গত সপ্তাহের শেষে তা নেমে দাঁড়ায় ২৫ ডলার ৮৮ সেন্টে। চলতি সপ্তাহে দাম আরও কমে গেছে। শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চেয়ে গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে এক সেমিনার আয়োজন করেন ব্যবসায়ীরা। ওই সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমের কাছে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবি তোলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এজন্য তারা প্রয়োজনে এলএনজি আমদানিতে বেশি দাম দিতেও প্রস্তুত বলে ওই সেমিনারে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ডলার ও রিজার্ভের বিদ্যমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে আমদানি ছাড়াই স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহের সংস্থান করা হবে বলে আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা।
এলএনজির দাম কমে আসার প্রেক্ষাপটে স্পট থেকে কার্গো আমদানির কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস ও পরিকল্পনা) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, স্পট থেকে এলএনজি কার্গো কেনার এ মুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই। দাম কমছে এটা ঠিক। তবে আরও সহনীয় পর্যায়ে এলে আমরা চিন্তাভাবনা করব।