বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আরোপিত লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
করোনা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে ব্যাপকভিত্তিক টিকা দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। এর মাধ্যমে করোনার মধ্যে থেকেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব হবে। করোনায় এখন পর্যন্ত যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলো মোকাবিলা করতে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। তখন সামাজিক ভারসাম্য ফিরে আসবে। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হুসেন।
অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় আগামী বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. নাজনীন আহমেদ : করনোর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে আগে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারপর এর বিস্তার ঠেকাতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্য খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাজেট করতে হবে। এজন্য যেমন বাড়াতে হবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, তেমনই বরাদ্দ অর্থ খরচ করার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। করোনা মহামারির কারণে গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সেগুলো খরচ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা মহামারি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে পারে।
করোনা যেভাবে তার রূপ পরিবর্তন করছে, তাতে ধরেই নিতে হবে একে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। সেজন্য করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন করাটা জরুরি। নতুন হাসপাতাল করতে হবে। আইসিইউ বেডের সংখ্যা অপ্রতুল, এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। যে কোনো বিপর্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিতে অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। অসচ্ছল মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসামগ্রী বিতরণ, স্বাস্থ্যবিধি পালনে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে নিশ্চিত করতে হবে হাটবাজার, মার্কেট, গণপরিবহণে সব সময় স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি।
সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে টিকা কার্যক্রমকে। দেশের বেশির ভাগ মানুষকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা, স্বল্প আয়ের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে।
টিকা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আপনি কি কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
ড. নাজনীন আহমেদ : টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করা এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। কারণ সব দেশই চাচ্ছে দ্রুত টিকা দিতে। কিন্তু টিকার উৎপাদন ক্ষমতা তো সীমিত। ইচ্ছা করলে বেশি উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এজন্য হয়তো একটু সময় লাগবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে। টিকার মাধ্যমে ক্ষতির প্রভাব কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা সম্ভব। এজন্য টিকায় অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
করোনা প্রতিরোধে লকডাউনে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের জন্য কী করতে পারে সরকার?
ড. নাজনীন আহমেদ : লকডাউন অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউনের আপাতত কোনো বিকল্প নেই। যদি লকডাউন দিতে হয় তবে দরিদ্র মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে হবে।
বড়রা ব্যাংক থেকে ঋণ পেলেও ছোটরা পায় না। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে যেসব আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় সেগুলো তাদের নেই। এজন্য তাদের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঋণ দিতে হবে। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকায় অনেকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফ, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা যায়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
করোনার গতিবিধি এখনো পরিষ্কার নয়। এ অবস্থায় পরিকল্পনা কীভাবে হবে?
ড. নাজনীন আহমেদ : করোনা কোনদিকে মোড় নেয় সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হবে। যদি কোনো বড় ধরনের আঘাত আসে, তাহলে যেন তা মোকাবিলা করতে পারি। নিম্ন আয়ের মানুষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রণোদনার সুবিধা পৌঁছে দিতে অবকাঠামো তৈরি করে রাখতে হবে। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেরকম সক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে।
করোনায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটি মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. নাজনীন আহমেদ : করোনার কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বিনিয়োগ কমেছে। মানুষের আয় কমেছে, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে কেউ উৎসাহী হচ্ছে না। নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগমুখী করতে হবে। গ্রামে নতুন ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যাতে আরও অনেকে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
করোনায় ই-কমার্সের ব্যবসা বেশ বেড়েছে। এ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। তাহলে তারা আরও কিছু লোকের কর্মসংস্থান করতে পারবে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ডের আকার আরও বাড়াতে হবে। এখান থেকে উদ্যোক্তাদের দ্রুত সহজ শর্তে ঋণ দিলে তারা দ্রুত কর্মসংস্থান করতে পারবে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে।
ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সবকটির বাস্তবায়ন হয়নি। কীভাবে এগুলো বাস্তবায়ন করা যায়?
ড. নাজনীন আহমেদ : প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মধ্যে বড়দেরগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। ছোটদেরটা বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে কেন হয়নি, সেটা দেখা দরকার। ছোট উদ্যোক্তাদের হয়তো ঋণের চাহিদা নেই। নাকি তারা ঋণ নিতে ভয় পান। তাদের অনেকেই নিজের টাকায় ব্যবসা করেছেন। এখন হয়তো ঋণ নিতে চাচ্ছেন না। তবে তাদের যে কোনোভাবে সহযোগিতা করে উৎপাদনে ফিরেয়ে আনলে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। তাদের ঋণের জোগান দিলে বিশেষ করে গ্রামে টাকার প্রবাহ যাবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
করোনায় অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। যারা নতুন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন তারাও পাচ্ছেন না। এতে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে তা মোকাবিলায় করণীয় কী?
ড. নাজনীন আহমেদ : যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জন্য সাময়িকভাবে খণ্ডকালীন কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউনের কারণে যেসব দৈনিক আয়ের মানুষ কর্মহীন হয়েছে, তাদের বিকল্প খাদ্য সহায়তা দেওয়া জরুরি। বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। করোনার মতো মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে বিকল্প প্রস্তুতি রাখতে হবে।
এজন্য প্রয়োজনে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে এসব খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। এখন কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যেসব শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে সেগুলোকে চালু করার ব্যবস্থা নিলে কর্মসংস্থানে গতি আসবে। সে কারণে আগামী বাজেটে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। সেগুলোকে দ্রুত কার্যকরও করতে হবে। তা না হলে সুফল মিলবে না।
করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করতে গত বছরের অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লেগেছে বলে মনে করেন?
ড. নাজনীন আহমেদ : গত বছরের মতো এবার লকডাউন হয়নি। এবার শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ফলে অর্থনীতি আগের মতো একেবারে স্থবির হয়নি। সীমিত হয়েছে। করোনার প্রভাব এবার কম-যেমন দেশে, তেমনই বিদেশে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো করোনা প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে টিকা দিচ্ছে।
ফলে তাদের দেশে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত যদিও এখনো করোনায় পর্যুদস্ত, তারপরও ভারত টিকা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। ফলে তারাও হয়তো নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে। বাংলাদেশকেও টিকার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনোভাবে টিকা সংগ্রহ করতে হবে। বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হলে লকডাউন দিতে হবে না। তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোও আগামী দিনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে।
এবার করোনার সময় অনেক কিছু খোলা ছিল। আগের মতো কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়নি। আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোয়ও দেওয়া হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু একেবারে স্থবির হয়ে যায়নি। এছাড়া গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে এবার করোনা মোকাবিলায় এক ধরনের সক্ষমতা হয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে করোনার প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে গিয়ে যাতে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না ঘটাতে পারে।
করোনায় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত আছে। কীভাবে এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে?
ড. নাজনীন আহমেদ : করোনার মধ্যে রপ্তানি আয়ে নিম্নগতি আছে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর মধ্যেও নিটওয়্যারের চাহিদা বেড়েছে। মানুষ ঘরে থাকছে বলে ওভেন পোশাকের চাহিদা কমেছে। কিন্তু নিটওয়্যারের চাহিদা বাড়ায় এগুলোর রপ্তানি বেড়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পমূল্যের পোশাক বেশি রপ্তানি করে।
করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানুষ উপরের স্তর থেকে নিচের দিকে নামে। ফলে যারা বেশি দামের পোশাক কিনত, তারা একুট কম দামের পোশাক কিনবে। যারা মাঝারি মানের পোশাক কিনত, তারা আরেকটু নিচের দিকে নামবে। এভাবে দেখলে দেখা যাবে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বাড়ছেই। ফলে রপ্তানিও ঘুরে দাঁড়াবে। চামড়াসহ কিছু খাতে বেশ ক্ষতি হয়েছে। এগুলো মোকাবিলা করা কঠিন হবে। একটু সময়ও লাগবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আসন্ন মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত?
ড. নাজনীন আহমেদ : করোনার কারণে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বাজারে এমনিতেই টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী। করোনার প্রভাব মোকাবিলা করতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। তবে যেটুকু বাড়ানো হয় তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে। বাড়বে মানুষের আয়। ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে যাবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে সুবিধা পেতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো নিরসনে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. নাজনীন আহমেদ : বৈদেশিক বাণিজ্যে সুবিধা পেতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে যেতে হবে। চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাইরে গিয়ে খুব বেশি কিছু করার নেই। এক্ষেত্রে কিছু করতে হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে যেতে হবে। এজন্য সরকারকে ব্যবসায়ীদের আরও সচেতন করতে হবে।