রমজান মাসে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে কোনো সুখবর নেই। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার পরও ইফতার, তারাবি এবং সেহরির সময় নগরবাসী একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাবেন না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। তার পরও লোডশেডিংমুক্ত করা যাচ্ছে না ঢাকাকে। আবার ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় ঢাকাকে আলোকিত রাখতে গ্রামে লোডশেডিং করতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই অবস্থা পানি ও গ্যাস সুবিধা নিয়ে। রোজায় গ্যাস সংকট থাকবে শিল্প-কল কারখানায়ও। এদিকে রোজার শুরুতেই রাজধানীর অনেক এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। দুপুরের পর থেকে ইফতার পর্যন্ত চুলা জ্বলছে নিভু নিভু করে।
তবে রোজায় দুর্ভোগ হবে- এমন কথা মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মতে, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের তেমন কোনো সমস্যাই হবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের মতে, লোডশেডিং এখন শূন্য। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রায় একই কথা বলছেন ওয়াসা এবং তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে এসব খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, জোড়াতালি দিয়ে সংকট নিরসন করতে গিয়ে সব ক্ষেত্রে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে রমজানে।
তাদের মতে, বর্তমানে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ৬০ থেকে ৯০ কোটি ঘনফুট। সংকট নিরসনে রমজানে কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হবে। একই সঙ্গে অনেক এলাকার শিল্প-কারখানায়ও গ্যাস কমিয়ে দেওয়া হবে। এতে গ্যাসের সাশ্রয় হবে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট বাড়বে। বাড়বে লোডশেডিং। বিদ্যুৎ না থাকার প্রভাব পড়বে পানি উত্তোলনে। অপর দিকে শিল্প-কারখানায় গ্যাস কমিয়ে দেওয়া হলে ব্যাহত হবে শিল্পোৎপাদন। আর শিল্প উৎপাদন কম হলে শ্রমিক-কর্মচারীরা সমস্যায় পড়বেন। ঈদের বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে রমজানের প্রথম দিনই রাজধানীর মোহম্মদপুর, শেখেরটেক, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, শংকর, কাঁঠালবাগান, মুধুবাজার, কলাবাগান, রামপুরা, ওয়ারী, মগবাজার, আরামবাগ, ফকিরাপুল, বনশ্রী, গোপীবাগ, মিরপুর, ইস্কাটন, মানিকদি, গোড়ান, পুরান ঢাকাসহ আরও কিছু এলাকায় গ্যাস ছিল না। কোথাও গ্যাসের চাপ এত কম ছিল যে, পানিও গরম করা যাচ্ছিল না।
রাজধানীর শেখেরটেকের ৬ নম্বর সড়কের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ‘দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি গ্যাস ছিল। দুপুরের পর একেবারেই নেই। ইফতারের জন্য কিছু রান্না করতে পারিনি। উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা নাফিসা আক্তার জানান, শনিবার রাত থেকেই গ্যাস নেই তাদের এলাকায়। রোববার দুপুরের পর চুলা জ্বালানো সম্ভব হয়নি। ইফতার বানাতে না পেরে দোকান থেকে কিনে আনতে হয়েছে। একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মগবাজার, রায়েরবাজার, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, রামপুরা, বনশ্রী ও মিরপুরের বাসিন্দারা। আরামবাগ এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘সকাল থেকেই গ্যাস খুবই কম ছিল। দুপুরের পর চুলা বন্ধ হয়ে যায়। একই অভিযোগ মিরপুরের বাসিন্দা জাহানারা বেগম ও গোপীবাগের দীপংকর করের।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিবিয়ানার ছয়টি কূপ বন্ধ। যার প্রভাব পড়েছে ঢাকায়। সংকট কাটতে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, ‘হঠাৎ বিবিয়ানায় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এ কারণে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের সমস্যা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিকাল নাগাদ একটি কূপ মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। আজকের মধ্যে আরও তিনটি কূপ উৎপাদনে আসবে বলে আশা করছি। এরপর আরও একটি কূপ চালুর কথা। তবে একটি কূপ মেরামত করতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছে শেভরন। ফলে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো ঘাটতি থেকে যাবে। ৮ এপ্রিল আমাদের একটি এলএনজির কার্গো দেশে পৌঁছাবে। এরপর ১০ এপ্রিল নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রীষ্ম এবং সেচ মিলিয়ে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা থাকে এপ্রিলে। মে থেকেই বৃষ্টির কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে থাকে। জুনের পর কিছুটা চাহিদা বাড়লেও জুলাই এবং আগস্টে এসে আবার কমতে শুরু করে। এপ্রিলে মোট বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৭৬৬ মেগাওয়াট, যা গত বছর ছিল ১৪ হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকার চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৯০৩ মেগাওয়াট; এবার হবে ৬ হাজার ৩১৬ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৪৫৬, এবার হবে ১ হাজার ৫৫৮ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহে ছিল ৭২২, এবার হবে ৭৭৩ মেগাওয়াট। সিলেটে ছিল ৫৭৪, এবার হবে ৬১৪ মেগাওয়াট। কুমিল্লায় ছিল ১ হাজার ৩২৭, এবার হবে ১ হাজার ৪২০ মেগাওয়াট। খুলনায় ছিল ১ হাজার ৭৬০, এবার হবে ১ হাজার ৮৮৩ মেগাওয়াট। বরিশালে ছিল ২৯৩, এবার হবে ৩১৪ মেগাওয়াট। রাজশাহীতে ছিল ১ হাজার ৭৫৪, এবার হবে ১ হাজার ৮৭৬ মেগাওয়াট। রংপুরে ছিল ৯৪৬, এবার হবে ১ হাজার ১২ মেগাওয়াট।
শনিবার দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট। রোদের তীব্রতা বাড়লে চাহিদা বেড়ে হবে ১৫ হাজার ৭৬৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদা আরও ২ হাজার ৩৯৭ মেগাওয়াট বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূল সংকট জ্বালানি। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে এর অর্ধেক ১ হাজার ১১৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এর চাইতে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা বেশ কঠিন। বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেও গ্রীষ্মে লোডশেডিং করতে হয়। শহরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করা হলেও গ্রামীণ জনপদে এ সময় লোড ম্যানেজমেন্ট করা হয়। তবে এই সংকট কাটাতে এবার আগেভাগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রীষ্ম এবং সেচকে সামনে রেখে যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, চলতি মৌসুমে আগের বছরের মতো লোড ম্যানেজমেন্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান পরিস্থিতিতে লোডশেডিং হবে না। যদি লোডশেডিং হয়ও তা সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে লোডশেডিং হবে না এটি জোর দিয়ে বলা যাবে না। পুস্তিকায় আরও বলা হয়েছে, লোডশেডিং হবে। কিন্তু তা থাকবে সহনীয় মাত্রায়। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, এ বছর রমজান মাসে গ্যাসের ঘাটতির কারণে নগরবাসীর যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য তিতাসের আওতাধীন সবগুলো স্টেশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার রমজান মাসের ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা হয়েছে।
সিস্টেমের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এবার লোড সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রথম রোজা থেকে পুরো লোড ডিসপার্স মনিটরিং করা হবে। যখন যেখানে লোড প্রয়োজন হবে সেখানে গ্যাস দেওয়া হবে। কাজেই ইফতার, সেহরিতে গ্যাসের কোনো সমস্যা হবে না। দুপুরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ফেসবুক পেজের একটি পোস্ট থেকে জানা যায়, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের জরুরি মেরামত ও সংরক্ষণ কাজের জন্য গ্যাস সরবরাহে ঘাটতিজনিত কারণে কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে।
ফলে কোনো কোনো এলাকায় সাময়িকভাবে সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এই অসুবিধার জন্য মন্ত্রণালয় আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বিবিয়ানার ছয়টি কূপ থেকে গত রাতে গ্যাস উত্তোলনের সময় বালি উঠতে শুরু করে। এ কারণে বন্ধ করে দিতে হয় উৎপাদন। এতে রাতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। আবাসিক এলাকায় সাধারণত প্রায় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এখন সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ১৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। একই কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহেও ঘাটতির শঙ্কা সৃষ্টি হলো। কারণ, দেশের প্রায় অর্ধেক কেন্দ এখনো গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, ‘চেষ্টা করছি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এখন তো গরম। এ সময় চাহিদা বেশি থাকে। ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় যাতে বিদ্যুৎ সংকট না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রোজায় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও যাতে পানি উঠানো যায় সেজন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, রমজানে সেহরি, ইফতার এবং তারাবির নামাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শহর এলাকার পাশাপাশি গ্রামেও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বলা হয়েছে। পেট্রোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তারিকুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে দেশের সব সিএনজি স্টেশন প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মোট ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক সারা দেশে সিএনজি স্টেশনসমূহকে উল্লিখিত সময়সূচি অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ভিজিল্যান্স টিম নিয়মিত মনিটরিং করবে। এতে আরও বলা হয়, সিদ্ধান্ত অমান্যকারী সংশ্লিষ্ট সিএনজি স্টেশনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ গ্যাস আইন, ২০১০ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।