আজ ঐতিহাসিক যশোর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোর জেলা হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। এদিন দুপুরের পর পরই যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উড়েছিল রক্ত সূর্যখচিত গাঢ় সবুজ পতাকা।
বিজয়ের ৫০ বছরে যশোর মুক্ত দিবসে বণার্ঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আজ দুপুরে যশোর শামস-উল-হুদা স্টেডিয়ামে আঞ্চলিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। আরও অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- বিজয়ের পথে পথে, থিম সংগীত প্রদর্শনী, সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ, নাট্যাভিনয়, শপথ পাঠ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, বিশেষ অতিথি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। এছাড়াও সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
যশোর মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করে।
এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস ছেড়ে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পলায়নকালে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর শহরতলীর রাজারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়।
৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় হানাদাররা। বিকেলে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তি বাহিনী সেনানিবাস দখল করে নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। পাড়া মহল্লায়ও চলে খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল। মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে ফেটে পড়েন গোটা জেলার মানুষ।
এর আগে ৩ মার্চ যশোর কালেক্টরেটের সামনে শহরের রাজপথে বের হয় জঙ্গি মিছিল। যশোরবাসী শপথ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের। এই মিছিলে হানাদার বাহিনী গুলি চালালে শহীদ হন চারুবালা কর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই যশোরের প্রথম শহীদ। এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও নারীদের। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী তদানিন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জননেতা মশিয়ূর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল শহরে আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দি। এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে।
হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই শহীদ হন। জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে থাকে। ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। তারা হানাদার বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের শক্তিশালী ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে। মিত্রবাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস।
২২ নভেম্বর রাতে পতন হয় চৌগাছার। হানাদার বাহিনী সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। এ অঞ্চলের হানাদার বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রাণ ভয়ে তার অফিস স্থানান্তর করেন খুলনায়। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে। মুক্ত হয় যশোর জেলা। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা।