সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসমর্থন আদায়ে সারা দেশে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি রাজপথে নিজেদের শক্তি দেখাতে চাইছে। সম্পূর্ণ এককভাবে এ কর্মসূচি পালন করছে, যাকে ‘কৌশলগত’ বলছেন নেতারা। গণসমাবেশে ব্যাপক জমায়েতের মাধ্যমে জামায়াতসহ জোটের শরিকদের ছাড়াই জনপ্রিয়তা যাচাই করছে। এছাড়া একদফা আন্দোলনের আগে সরকারকে শক্তি দেখানো ও বিদেশিদের কাছে জনভিত্তির প্রমাণ দেওয়া- মূলত এ তিন বার্তা দিতে চায় দলটি।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই দেশে-বিদেশে নানাভাবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাধা সত্ত্বেও বিভাগীয় গণসমাবেশে জনস্রোত প্রমাণ করে বিএনপি এককভাবেই অনেক শক্তিশালী ও জনপ্রিয় একটি দল। প্রতিটি সমাবেশে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি নেতাকর্মীর সমাগম হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে। গণসমাবেশের আগে যারা বিএনপিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন, এখন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তারাও এগিয়ে আসতে চাইছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়-এ দাবি আরও বেশি জোরদার হচ্ছে। দাবি আদায়ে ঢাকা থেকে পরবর্তী আন্দোলনের দিকনির্দেশনা আসবে। এরপর একদফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে বলেও জানান নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন জোটবদ্ধ না করে এককভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিএনপি তার নিজের শক্তিতে বলীয়ান। আমরা কেন অন্যের শক্তি ধার করতে যাব। আমরা নেতাকর্মীদের সবার মতামত নিয়েই একা শুরু করেছি।’
তিনি বলেন, ‘গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে পরিবহণ ধর্মঘটসহ নানা বাধা দিয়েও জনস্রোত ঠেকানো যায়নি, যাবেও না। গণঅভ্যুত্থান ঘটবেই। সামনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আমার নিজের এলাকা সিরাজগঞ্জে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। নেতাকর্মীদের ভয় দেখাচ্ছে, আবার উলটো মামলাও করছে। এভাবে প্রতিটি জেলায় নির্যাতন-হয়রানি চলছে। সবকিছু উপেক্ষা করে গণসমাবেশে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করছে বিএনপি কতটা জনপ্রিয় দল। আওয়ামী লীগ বলে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বলেন বিএনপি কোনো দলই না। কিন্তু গণসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি একক যে শক্তি তা প্রমাণ হয়েছে।’ তিনি জানান, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে। অন্যরাও আসবে। তাদের সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলন করব। জোটবদ্ধভাবে আর আন্দোলন করছি না আমরা।
এককভাবে কর্মসূচির তাৎপর্য প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘প্রথমে বিএনপিকে নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে হবে। সেটাই আমরা করছি। তারপর বিএনপির সঙ্গে যারা আসবে, তাদের অবশ্যই স্বাগত জানাব। সরকারবিরোধী সব দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন হবে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন-লুটপাট, গুম-খুন-মিথ্যা মামলা, হয়রানি-নির্যাতন আর কত সহ্য করবে দেশের মানুষ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন তারা দিশেহারা, সংসার চলছে না। তাই বিএনপির যে দাবি সাধারণ জনগণেরও একই দাবি। হয় মরব, না হলে দাবি আদায় করে ছাড়ব-মানসিকভাবে এ রকম প্রস্তুতি নিয়েই এবার আমরা মাঠে নেমেছি।’
বিশদলীয় জোটের নেতৃত্বে রয়েছে বিএনপি। এ জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতকে ঘিরে বিএনপির ভেতরে এবং বাইরে সমালোচনা আছে। দলের মধ্যেও অস্বস্তি আছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতকে বাদ দিয়ে একক আন্দোলন রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ কিনা তা নিয়েও নানা মহলে আলোচনা চলছে।
বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, গণসমাবেশে বেশি লোকসমাগমের কারণ হলো-খালেদা জিয়ার প্রতি যে অবিচার তা মানুষ মনের মধ্যে পুষে রেখে গণবিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আরেকটি কারণ, দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমান প্রান্তিক জনতাকে নিয়ে, বিশেষ করে তৃণমূল নিয়ে যে কাজ করেছেন তার সংঘবদ্ধ একটি রূপ। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জনস্বার্থে বিএনপির কর্মসূচিও আরেকটি কারণ। বিএনপি গণদাবিকে সম্পৃক্ত করেছে দেখেই মানুষ আসছে, পাশে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং যত বাধা-বিপত্তি আসবে রাজনৈতিকভাবে সহনশীলতা ও কৌশল দিয়েই মোকাবিলা করা হবে। এবার ‘ডু অর ডাই’- এই প্রত্যয় নিয়ে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সিনিয়র সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘ছয়টি সাংগঠনিক বিভাগে গণসমাবেশ হয়েছে। প্রতিটিতে ঢাকা থেকে অনেক সিনিয়র নেতা অংশ নেন। পরিবহণ ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার পরও এত জনসমাগম দেখে তারাও অবাক হয়েছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তৃণমূল পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই। যে কারণে দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে আরও উদ্দীপ্ত হয়ে নেতাকর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বাড়ছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এককভাবে বিভাগীয় গণসমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। এতে করে একদিকে বিদেশি শক্তিগুলোর বিএনপির দিকে দৃষ্টি বাড়ছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের (বিএনপি) দিকে ঝুঁকবে। বিএনপি ক্ষমতাসীন দলকে মেসেজ দিতে চায়, তাদের এখন বেশি জনসমর্থন আছে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি না মানলে তারা আগামী দিনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ মনে করেন, ‘গণসমাবেশে বিপুলসংখ্যক জনসমাগমের কারণ মানুষ একটা পরিবর্তন চায়। যদিও এক সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। দীর্ঘ বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে। মানুষ এখন ভাবতে চায় বিএনপি আরও পরিশুদ্ধ হয়েছে। তাই তাদের (বিএনপিকে) সমর্থন দেওয়া দরকার। আর এখন সমর্থন যে পাচ্ছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিভাগীয় গণসমাবেশে মানুষ আসছে। তার মানে মানুষের মধ্যে একটা প্রত্যয় কাজ করছে প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন হোক।’ চট্টগ্রাম থেকে শুরু করেছে বিএনপির দশ সাংগঠনিক বিভাগীয় গণসমাবেশ। ইতোমধ্যে ছয় বিভাগে কর্মসূচি শেষ। সামনে পর্যায়ক্রমে সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহীতে গণসমাবেশ রয়েছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দলটির দ্বিতীয় পর্যায়ের এই কর্মসূচি।