তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন হয় ২০১২ সালের জুলাইয়ে। প্রকল্পের আওতায় সংস্থান আছে ঢাকা সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে আটতলা ভবন নির্মাণের। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কলেজসমূহে বর্ধিতহারে ভৌত সুবিধা এবং শিক্ষা উপকরণ অর্জন করা। এছাড়া একাডেমিক ভবন, ইন্টারনেট সুবিধাসহ কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্মার্ট ক্লাসরুম, ফার্নিচার ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়াও উদ্দেশ্য।
সরকারি ও বেসরকারি কলেজসমূহের মধ্যকার ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধার পার্থক্য কমানো, পুরো বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার সুযোগের ভারসাম্য এবং সমবণ্টন নিশ্চিত করা। জেলা ও উপজেলা সদরে অবস্থিত কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির অতিরিক্ত চাপ কমানো। নভেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত, এক দশক পেরিয়ে, প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৭৭ শতাংশ। অথচ শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের জুনে।
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চার ধাপে ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় সময়। এখন নতুন করে আরও দুই বছর, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তর দিতে রাজি হননি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা) আনিকা রাইসা চৌধুরী।
এভাবে একের পর এক প্রকল্পে আসছে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব। এতে বাড়ছে ব্যয়। সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাস না যেতেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে চলমান ১৭৫ প্রকল্পের। চলতি অর্থবছর আটটি একনেক সভায় ২৪টি প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় একসঙ্গে বাড়ানো হয়। ফলে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে সুফল থেকে বঞ্চিত হয় সংশ্লিষ্টরা।
তবে বৈশ্বিক মন্দা ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বার বার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে কঠোর হচ্ছে আইএমইডি।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব এলেই অনুমোদন নয়। আমরা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাবো। কেন প্রকল্প ডিলে (দেরি) হচ্ছে, কে দায়ী? এ বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো সঠিক সময়ে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করে সুফল দিতে হবে। বার বার মেয়াদ বৃদ্ধি নয়। কারণ মেয়াদ বৃদ্ধি মানেই টাকা বৃদ্ধি করতে হয়। বড় প্রকল্প দ্রুত অর্থায়ন করে শেষ করবো। যেগুলো শুরু করা হয়নি, দরকার হয় পরের বছরে অর্থ বরাদ্দ দেবো। সময় মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।
এর আগে উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে এসে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ খরচ বাড়ে ৩১৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে আবার ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন আমদানি খাতে খরচ বাড়ছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে এখন এ প্রকল্পে খরচ হবে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এর আগে সময় দেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
২০১৫ সালে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি যখন পাস হয়, তখন এই প্রকল্পের খরচ ছিল আট হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। পরে যথাসময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম দফা সংশোধন করে খরচ ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন আবার খরচ বাড়ানো হচ্ছে। এই প্রকল্পে অর্থ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
যদিও প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে ও ব্যয় কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দ্রুত কাজ করেন। খরচ কম করেন। তবে খরচ বন্ধ করা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় করতেই হবে।
গত ১৭ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এমন নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনাও নতুন নয়। দেশের টাকা সাশ্রয় করে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ আগেও একাধিকবার দিয়েছেন তিনি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মঙ্গলবারের একনেক সভায়ও ১১টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়।
আইএমইডি সূত্র জানায়, সেক্টরসমূহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাসে মোট ১৭৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২১টি প্রকল্পের প্রতিবেদন জারি করে সভা করা হয়েছে এবং ৫৪টি প্রতিবেদন পেন্ডিং।
মেয়াদের সঙ্গে বাড়ছে ব্যয়
সাধারণত ব্যয় ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে আইএমইডি। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করতে হলে অনুমোদন লাগে একনেক সভার। চলতি অর্থবছর এ পর্যন্ত আটটি একনেক সভা হয়েছে। সভাগুলোতে নতুন এবং সংশোধনী মিলিয়ে মোট ৩৯টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ২৪টি মেয়াদ বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পে কয়েক দফায় মেয়াদ বেড়েছে এক থেকে আট বছর পর্যন্ত। মেয়াদ বাড়ানোর কারণে প্রকল্পগুলোতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আরও ৮ থেকে ১০টি প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে পরবর্তী একনেকে। এর বাইরে আরও কিছু প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো।
২০২১-২২ অর্থবছরে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন পায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৩৮টি প্রকল্প। তাতে ৪০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদিও বিভিন্ন একনেক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন সম্পর্কে অবহিত করেন। সংবাদ সম্মেলনগুলোতে প্রায়ই জানানো হয়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর ধারা বন্ধ করে নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।
মেয়াদ বৃদ্ধিতে বাড়ছে ব্যয়, ব্যাহত উন্নয়ন
মেয়াদ বাড়ানোর তালিকায় সবচেয়ে বেশি রয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্প। চলতি অর্থবছরের ষষ্ঠ একনেক সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চতুর্থবারের মতো। এ নিয়ে চার দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়লো আট বছর। ব্যয় বেড়েছে ১৬০ কোটি টাকা।
একই মন্ত্রণালয়ের ‘উত্তরা লেক উন্নয়ন’ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফায় বেড়েছে সাত বছর। ব্যয় বেড়েছে ৫৩ কোটি টাকা। ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে ৪৬৯ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য বিভাগের গোপালগঞ্জে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপনের মেয়াদ পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে আট বছর। ব্যয় বেড়েছে ২৪১ কোটি টাকার বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি (ইপিসিবিসিএসপি) প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে তিন বছর, আর ব্যয় বেড়েছে ১২৯ কোটি টাকার বেশি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি জাতীয় মহাসড়কের হাটহাজারী থেকে রাউজান পর্যন্ত চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে দুই বছর। ব্যয় বেড়েছে ১০৪ কোটি। এই বিভাগের ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এক বছর। ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম জেলার ‘বারইয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ’ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। ব্যয় বেড়েছে ২৬১ কোটি টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ‘নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১৮৩ কোটি টাকা। বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর জাতীয় মহাসড়কের (এন-৮০৯) বরিশাল থেকে ভোলা হয়ে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত সড়কের মান ও প্রশস্ততা উন্নীতকরণ প্রকল্পটির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে ১৯০ কোটি টাকা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘বিসিক মুদ্রণ শিল্প নগরী’প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চার বছর । ব্যয় বেড়েছে ১২৬ কোটি টাকা। ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার’ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। ব্যয় বেড়েছে ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
কারা অধিদপ্তরের রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফায় বেড়েছে পাঁচ বছর। ব্যয় বেড়েছে ২৫ কোটি টাকা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর স্থাপন’ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। ব্যয় বেড়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ‘আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ (বাংলাদেশ অংশ)’ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে পাঁচ বছর।
তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, দ্রুত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেন হয়, মেয়াদ যাতে না বাড়ে, সেজন্য চেষ্টা করছে তারা।
বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত সময়ে যাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। সংশ্লিষ্ট সচিব ও প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে বৈঠক করবো। আমাদের দিক থেকে চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি। প্রকল্পে সময় বাড়লে সম্পদের অপচয় হয়। আবার প্রকল্পের কার্যকারিতাও কমে যায়।