নচিকেতা চক্রবর্তী। যাকে সবাই নচিকেতা নামেই চেনেন। যিনি জীবনমুখী বাংলা গান গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন। দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয়। এই কালজয়ী শিল্পীর কন্যা ধানসিঁড়ি সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। এমনি নচিকেতার মেয়ে যে গানও চায় তাও বুজি অনেকেই জানেন না।
সম্প্রতি ভারতের একটি গণমাধ্যমে ধানসিঁড়ি তার বাবা নচিকেতা সম্পর্কে অকপটে নানা তথ্য জানিয়েছেন। যা অনেকেরই অজানা। এমনটি নিজের গানের জগতে কীভাবে আসলেন সে সম্পর্কেও বলেছেন।
নচিকেতা কন্যা ধানসিঁড়ির বয়ান থেকেই শুনুন…
‘জীবনে এমন অনেক কথাই থাকে যা সবক্ষেত্রে তেমনভাবে প্রকাশ করা সত্যিই যায় না। অনেকেই কখনও কখনও প্রশ্ন করে শিক্ষক নচিকেতা ঠিক কেমন। আসলে গায়ক হিসেবে তো সবাই দেখেছে বাবাকে। তবে শিক্ষক হিসেবে খুব কম মানুষই হয়তো চেনেন। আর মেয়ে হওয়ার সুবাদেই বলব খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তবে একদিনে বসে যে বহু তালিম বহু ক্লাস বাবা কখনও দিয়েছেন এমনটা কিন্তু নয়। বা বাদ্যযন্ত্র হাতে ধরে সেই তথাকথিত শিক্ষাও নয়। আসলে বাবা আমার বোধের জনক।
আমি অনেক ছোট থেকেই দেখেছি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাবা। অনেকেই নানা সমস্যা নিয়ে আসতেন বাবার কাছে। ডনের মতো দেখেছি মানুষটাকে। সেখান থেকেই আমার ভেতরেও একটা অন্যরকম ভাবধারা তৈরি হয়েছে। যা আর পাঁচটা মানুষের থেকে আমায় একটু আলাদা করে তোলে। আর যারা আমাকে এভাবে বেড়ে উঠতে দেখেছে, আমার মনটা বুঝতে পেরেছে, তারাই পরবর্তীকালে আমার বন্ধু হয়েছে। কিন্তু, বাবাকে ছোট থেকে দেখে যতটুকু বুঝেছি, সেটাই আমার শিক্ষা। সত্যি বলতে বাবা তো খুব একটা সময় দিতে পারত না আমায়। প্রতিদিন বাবার প্রোগ্রাম থাকত।
বাবার সঙ্গে আসলে সেভাবে গল্প করা, হাসিঠাট্টার সময় পাইনি কখনও। তবে যতটুকু সময় কাটিয়েছি, তখন বুঝেছি আমাদের প্রচুর মিল। সেটা রক্তের সম্পর্কের জন্য, নাকি সেই বোধটা আমার মধ্যে এমনিই তৈরি হয়েছিল সেজন্য সেটা ঠিক জানি না। অনেক ভাবনাচিন্তা আমাদের মেলে, আবার অনেককিছু মেলেও না। সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করি। আমাদের বাহ্যিক জিনিসকে দেখে কখনও মনে হয় না দারুণ। আমরা ব্র্যান্ডে বিশ্বাস করি না। আমরা স্টাইলিশ। আমরা সবসময় মনে করি একটা মানুষকে একটা ব্র্যান্ড দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না। আমরা মনে করি যেটা তাকে মানায়, সেটাই একটা ব্র্যান্ড তৈরি হতে পারে।
তবে ছেলেবেলার বেশকিছু সুন্দর স্মৃতি মনে পড়ে মাঝেমধ্যে। আমি কলেজ জয়েন করার পর দেখেছি, আমার বন্ধু-বান্ধবরা বাবাকে দাদা বলে সম্বোধন করত। ওদের কখনও কাকু বলতে দেখিনি। আর বাড়িতে এলে ওরাও কনফিউশড হয়ে যায় বাবাকে দাদা ডাকবে না কাকু। আর মাকে কী ডাকবে কাকিমা ডাকবে না বউদি। মা নিজেও এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। আমার জেনারেশন বা আমার থেকে জুনিয়র, তারাও বাবার গান শোনে। কারণ, সকলেই তো জীবনের সঙ্গে রিলেট করতে পারে বাবার লেখা।
সবচেয়ে বড় কথা কখনও কখনও পরিস্থিতি অনুযায়ী দেখি বাবার বহু গান ভাইরাল হয়। তখন হয়তো মানুষ ভাবে যে গানগুলো আজ লেখা। আসলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে লেখা সেই গানগুলো আজও রেলিভেন্ট। তাই সারাজীবনে যতবারই এ গান শুনবে মানুষ, নিজেকে রিলেট করতে পারবে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে তাঁর গান।
বাবার গান গাওয়ার থেকেও তাই শুনতে বেশি ভালোলাগে আমার। আসলে আমি বাবার গান খুব কম গাই। প্রথমত, খুব নার্ভাস লাগে। দ্বিতীয়ত, আমাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে সবসময় তুলনা করা হয়। যেটার সত্যিই হয়তো খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ, আমার একটা মহিলা কণ্ঠ। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি আমার মতো। আর সেটাই হতে চাই। আমার মনে হয় অনেকে উত্তরাধিকার, যোগ্য উত্তরসূরি এসব নিয়ে নানা কথা বলে। আমি কিন্তু সত্যি বলতে উত্তরসূরি হতে আসিনি। আমি ধানসিঁড়ি চক্রবর্তী হতেই এসেছি। অবশ্যই সেখানে বাবার অনুপ্রেরণা থাকবে। তবে নচিকেতার মেয়ে হিসেবে তাঁর মতো গাইতে হবে এটা কখনও সম্ভব নয়। বাবা আর আমি দু’জনেই অবশ্য জানতাম এমন তুলনা আসবে। তাই এসব শুনলে হালকা হেসে এখন উড়িয়ে দেই।
শিক্ষক দিবসে আর একজনের কথা তো বলতেই হয়। আমার মা। আমায় এতকিছু শিখিয়েছে যা কখনও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমরা অনেককিছু খুব সহজে অবহেলা করি। সেগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবিও না। মা সেসবের খেয়াল রেখেছে সবসময়। আমার বেড়ে ওঠার কারিগর আমার মা। কোথায় কোন কথা বলতে হয়, কতটুকু বলতে হয় সব পথ তার দেখানো।
এগুলোর কোনওটাই আসলে তেমন চামচ করে খাইয়ে শিখিয়ে দেওয়া যায় না। আমি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, সেটাই আমার জীবনের অন্যতম বড় পাওয়া। মাকে জীবনে সবচেয়ে কাছ থেকে পেয়েছি। বাবা যেহেতু সময় দিতে পারত না। আর একটা বিষয় হল, মাকে পেয়ে যাওয়া মানেই তো বাবাকে পেয়ে যাওয়া। ওনাদের দুইজনের মধ্যে এতটাই মিল। দুইজন দুইজনকে এত ছোট থেকে চেনে। বাবা কী বলতে পারে, আমার জন্য বাবা কী ভাবতে পারে সেটাও মা জানে।’