বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কাছ থেকে সময় মতো বিল না পেয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন সংস্থা বাপেক্স। ফলে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে এক চিঠিতে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই উল্লেখ করেছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংকট মেটাতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এফডিআর ভেঙে সরকারের ভ্যাটের অর্থ শোধ করতে হচ্ছে।
তবে একজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, বাপেক্সের এই সংকট নতুন নয়। অব্যবস্থাপনার কারণে আগে থেকেই সংকট চলছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিতে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটি বাপেক্সের তরফ থেকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি- বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে দিয়ে অবিলম্বে তাদের কাছে পাওনা ১১৪ কোটি টাকা শোধ করতে বলা হয়েছে।
যদিও মো. শোয়েব বলছেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া বিল রয়েছে। সেই টাকা আদায় করতেই চিঠিতে সংকটের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এটি অর্থ আদায়ের জন্য চাপ দিতে লেখা হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে সংকট নেই। নিয়মিত কার্যক্রম থেকে শুরু করে সবকিছুই স্বাভাবিক। তবে সময়মত বিল ও ভ্যাটের টাকা না আসায় ওভাবে চিঠি লেখা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলছেন, যেসব সরকারি সংস্থার কাছ থেকে বাপেক্সের টাকা পাওনা আছে, সেগুলো আদায়ের জন্য তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করছেন।
তিনি বলেন, যেভাবে সংকটের কথা বলা হচ্ছে পরিস্থিতি মোটেও তা নয়। এটা রেগুলার ইস্যু। বিল হয় ও ধারাবাহিকভাবে টাকা আসবে। কখনো কোনো সংস্থার কাছ থেকে টাকা আসতে দেরি হলে চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। এটাকে বড় করে দেখার কিছু নেই।
যদিও সব মিলিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কি পরিমাণ অর্থ বাপেক্সের পাওনা আছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য কর্মকর্তারা দিতে চাননি।
অধ্যাপক বদরুল ইমাম একজন জ্বালানিবিষয়ক বিশ্লেষক। তিনি অবশ্য বলছেন, বাপেক্সের এই সংকট এখন তৈরি হয়নি। অব্যবস্থাপনার কারণে এটি আগে থেকেই চলছে।
উল্লেখ্য, দেশের তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন করে থাকে। এগুলো হলো, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)।
বাপেক্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে তাদের উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্র আছে সাতটি। এছাড়া অনুসন্ধান কূপ আছে আঠারটি।
বাংলাদেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাপেক্স অনেকদিন ধরেই সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এমনকি এক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির চেয়েও বাপেক্সের সাফল্যের হার বেশি।
বাপেক্স কি আসলেই সংকটে!
গেল ২০ আগস্ট বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে বকেয়া বিল পরিশোধে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন সময় মতো বিল পরিশোধ না করায় বাপেক্সে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে।
ওই চিঠিতে বাপেক্সের সরকারি কোষাগারের নিয়মিত পাওনা পরিশোধ, টেকসই অনুসন্ধান, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা ও বাপেক্সের আর্থিক তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু চলতি বছরে মে মাসের বিল ও বকেয়াসহ মোট ১১৪ কোটি টাকা পাওনা বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিকে পরিশোধের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বকেয়া অর্থ আদায় না হওয়ায় সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রমে কিছু সমস্যা হবে।
মূলত গ্যাস কূপ খনন করার জন্যই বাপেক্স অর্থ ব্যয় করে থাকে এবং পরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিল পেলে তা দিয়ে তারা নিজস্ব খরচ বহন করে।
আবার গ্যাস বিক্রি করলে সরকারকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় ৯০ দিনের মধ্যে। অন্যথায় জরিমানা গুনতে হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সময় মতো ভ্যাটের টাকা না পেলে বাপেক্স নিজের তহবিল থেকে সেটি পরিশোধ করে।
এভাবেই কিছু সরকারি সংস্থার কাছে বিল ও ভ্যাটের টাকা দুটোই আটকে আছে। একই সাথে বিল ও ভ্যাটের টাকা আটকে থাকাতেই কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যদিও তার দাবি— এতে করে সংকটময় কোনো পরিস্থিতি সংস্থার কার্যক্রমে তৈরি হয়নি।
জানা গেছে, গেল বছরের শুরু থেকেই কিছু কোম্পানি ভ্যাট বাবদ অর্থ দেওয়া বন্ধ রাখায় বাপেক্সকে নিজ তহবিল থেকে তা সরকারকে শোধ করতে হয়েছে।
আবার এর মধ্যেই সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি কর্মকর্তা কর্মচারীদের একাধিক বোনাস দিতে হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা দাবি করেন— বিশেষ কিছু অর্জনের জন্য এই বোনাস দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে পরিকল্পিত কিছু কাজ করতেই পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে কিছু যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানি করা যায়নি ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায়।
কিছু কূপ খননযন্ত্র মেরামত ও আধুনিকায়নের জন্য ওই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল দু’বছর আগে। যদিও চার দশকের পুরনো খননযন্ত্র মেরামতের পরিকল্পনায় খুব বেশি সায় ছিল না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিভাগের। অথচ এর মধ্যেই ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা আছে সরকারের জ্বালানি বিভাগের, যার বেশিরভাগই করার কথা বাপেক্সের।
এখন একদিকে অর্থ সংকট, অন্যদিকে কূপ খননযন্ত্র পরিকল্পনা অনুযায়ী মেরামতের পদক্ষেপ নিতে পারায় ওই পরিকল্পনা কতটা আলোর মুখ দেখবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সংকট উত্তরণে বাপেক্স, পেট্রোবাংলা ও বিশেষজ্ঞ মত
বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব বলছেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজই তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
জ্বালানিবিষয়ক বিশ্লেষক অধ্যাপক বদরুল ইমাম অবশ্য বলছেন, বাপেক্সের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গ্যাসের গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হলেও সেই অর্থ অন্যত্র কাজে লাগানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এই তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে এলএনজিতে। এতে বাপেক্সের কোনো কাজ হয়নি। আবার বাপেক্স সরকার থেকে এখন আর অনুদান পায় না। বরং তাদের সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সুদসহ ফিরত দিতে হয়। এসব মিলিয়ে অনেকদিন ধরেই বাপেক্স আর্থিকভাবে সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।
তার মতে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত বাপেক্সের পাশে দাঁড়ানো। কারণ গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সকে সহায়তা করা তাদেরই দায়িত্ব।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার অবশ্য বলছেন, বকেয়া অর্থ আদায় বাপেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সাথে আলোচনা করছেন। তিনি বলেন, এটা এমন কিছুই নয়। সরকারি সংস্থাগুলো থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় হয়। সেজন্য কখনো কখনো দেরি হয়। এছাড়া আর কোনো সংকট নেই। বকেয়া অর্থও নিয়মিতভাবে চলে আসবে। সূত্র: বিবিসি