দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে টেলিযোগাযোগ শিল্পের সর্বাত্মক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাজেটে এই শিল্পের কোনো সুপারিশই মূল্যায়ন করা হয়নি, যা দুঃখজনক। মঙ্গলবার (জুন ৮) বাজেট পরবর্তী এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটব নেতারা। তারা সরকারকে টেলিযোগাযোগ খাতের সুপারিশগুলো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।
প্রতিনিয়ত টেলিযোগাযোগ শিল্প বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার কথা উল্লেখ করে এমটবের সেক্রেটারি জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) বলেন, ২০১৯ সালে মোবাইল বাজারের রাজস্ব ছিল দেশের জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং এই খাতটির কর ও ফি দেওয়ার পরিমাণ ছিল মোট সরকারি কর রাজস্বের প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তার মানে অর্থনীতিতে মোবাইল খাত সংশ্লিষ্ট করের অবদান এর আকারের ৪ দশমিক ২ গুণ।
এস এম ফরহাদ আরো বলেন, মোবাইল কাভারেজের বিস্তৃতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (একক গ্রাহক হার ৪৬ শতাংশ) এখনো মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেননি। তাই ডিজিটাল অন্তর্ভূক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে মোবাইল খাতে কর কাঠামোর সংস্কার। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ)-এর মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মোবাইল ব্রডব্যান্ডের ব্যবহার ১০ শতাংশ বাড়লে মাথাপিছু জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সুতরাং করের মাত্রা কমিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে সহজেই ত্বরান্বিত করতে পারে সরকার।
মোবাইল খাতে কর যৌক্তিকতার দাবিগুলো হলো- অলাভজনক অপারেটরের ওপর ন্যূনতম ২ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স প্রত্যাহার বা যুক্তিসঙ্গত করা। উচ্চ করপোরেট করের হারকে যৌক্তিক এবং সহনীয় পর্যায়ে হ্রাস করে তালিকাভুক্ত (বর্তমান ৪০ শতাংশ) ও অ-তালিকাভুক্ত (বর্তমান ৪৫ শতাংশ) অপারেটরদের কর ২৫ শতাংশ ও ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনা। সরাসরি অপারেটর বিলিং থেকে পরিপূরক শুল্ক ও সারচার্জ প্রত্যাহার। সব ইনট্যাঞ্জিবল সম্পদের ওপর এমোরটাইজেশন সুবিধা দেওয়া। মোবাইল সিমের ওপরে আরোপিত ২০০ টাকা কর বিলুপ্ত করা। প্রতি ১০০ টাকা টক টাইমের ওপর ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভ্যাট, এসডি ও সারচার্জ যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা। সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য ভ্যাট ছাড় সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা গাইডলাইন দেওয়া এবং অপরিশোধিত ভ্যাটের ওপর আরোপিত সুদ যৌক্তিক করা।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, টেলিকম অপারেটরদের যুক্তিসঙ্গত কয়েকটি দাবি প্রস্তাবিত বাজেটে বিবেচিত না হওয়ায় আমরা আশাহত হয়েছি। এই বিষয়গুলোর ওপরে নজর দেওয়া হলে মোবাইল ফোন গ্রাহকরা আরও বেশি সুবিধা পেতেন। টেলিকম খাতে করের হার বাস্তবসম্মতভাবে কমানো হলে আমাদের বিনিয়োগকারীরা অবশ্যই এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখনও আশাবাদী যে, কর্তৃপক্ষ এমন একটি কাঠামো তৈরি করবে, যা গ্রাহকদের সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত ডিজিটাল সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
গ্রামীণফোনের ডিরেক্টর এবং হেড অব পাবলিক অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত বলেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে টেলিযোগাযোগ খাতকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এটি সবাইকে সবসময় যোগাযোগের আওতায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ডিজিটাইজেশনের যাত্রা ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করছি এবং বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করছি। আমাদের বিশ্বাস, কর ব্যবস্থাকে যৌক্তিক পর্যায়ে ঢেলে সাজালে ডিজিটাল যাত্রা আরো গতিশীল হবে এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আমাদের অবদান আরো সমৃদ্ধ হবে।
রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, আমাদের দাবিগুলো সামগ্রিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উত্থাপন করা সত্ত্বেও একটি শিল্প হিসেবে প্রতি বাজেটেই আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো এই খাতের কর কাঠামো নিয়ে একটি বিশদ গবেষণা পরিচালনা করার। এতে পারস্পরিক ও আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হবে। এর ফলে দেশের ডিজিটাল সম্ভাবনা আরো বিকশিত হবে।