উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারলে রফতানির প্রধান বাজারগুলো হারাতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি করোনার সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
রোববার (১৩ জুন) ঢাকায় বাজেট পরবর্তী এক আলোচনা সভায় এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। ‘রিফ্লেকশনস অন দ্য বাজেট ২০২১-২২’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও গবেষণা সংস্থা রিসার্স পলিসি ইন্ট্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ও র্যাপিড চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন।
ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট করহারে ছাড়ের বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। তবে বাজেটটি এমন সময় হয়েছে যখন আমাদের সামনে করোনা সংকট থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনার পাশাপাশি ভ্যাকসিনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া শেষ না হলে বায়াররা (ক্রেতারা) আসবেন না। ভ্যাকসিন দিতে না পারলে আমাদের সঙ্গে বায়ার দেশের বিমান চলাচলও স্বাভাবিক থাকবে না। ফলে রফতানি বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
ভ্যাকসিনেশন জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসানও। তিনি বলেন, আমরা ভ্যাকসিনেশনে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছি। এটি বাড়াতে হবে। ভ্যাকসিনেশনে পিছিয়ে থাকলে রফতানিতেও পিছিয়ে যেতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাকসিনের জন্য বরাদ্দকৃত ১০ হাজার কোটি যথার্থ নয় জানিয়ে এ সংকট মোকাবেলায় থোক বরাদ্দের সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ভ্যাকসিনেশন না হলে আমাদেরকে বিভিন্ন দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। ফলে যতদ্রুত সম্ভব মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
প্যানেল আলোচনায় ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করার দরকার ছিল স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায়। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা হয়নি। বরাদ্দ আগের বছরের মতোই থেকেছে। এখন ভ্যাকসিনিশেন মূল চ্যালেঞ্জ। ভ্যাকসিনটা অতি জরুরি দরকার।
বাজেটে কিছু সংখ্যায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি তথ্যে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হার একই রকম বা বেশি। অন্যদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ওঠা-নামা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঠিক তথ্য জোগাড় করা হয়নি। সরকারি পর্যায়ে কোনো গবেষণা হয়নি। কাদেরকে সহায়তা দিতে হবে সে জায়গাটি ক্লিয়ার হয়নি। ফলে বাজেটের আকার আরেকটু বাড়িয়ে সোশ্যাল সিকিউরিটিতে ব্যয় বাড়ানো যায়নি।
ভ্যাকসিনেশনে জোর দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন প্রধান অতিথি পরিকল্পনা এম এ মান্নানও। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে সবাই কথা বলছেন। ভ্যাকসিন না নিলে, হার্ড ইমিওনিটি না হলে আমাদের বায়াররা এখানে আসবেন না। এটা হলে আমরা কোথায় যাবো? আমার মনে হয়, এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে বলে আমি মনে করি।
এর আগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, মহামারি চ্যালেঞ্জ, এলডিসি থেকে উত্তরণ, এসডিজি গোল অর্জন এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সামনে রেখে বাজেট ঘোষিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এই লক্ষ্যগুলো ঠিক রেখে প্রণয়নের দরকার ছিল।
তিনি বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এক শতাংশের মতো। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এটি ২ শতাংশ করার কথা বলা রয়েছে। ফলে বাজেটে এর বাস্তবায়ন নেই। সিএমএইচসহ ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মতো জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার। বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ দরকার।
স্বাভাবিক সময়ের মতোই সাত দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভুল বার্তা দিচ্ছে কি না, তা ভাবা দরকার বলে করেন তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশন উত্তরণ পরবর্তীতে সময়কে মাথায় রেখে বাজেটটি প্রণয়ন হওয়া দরকার ছিল। কয়েক বছর ধরেই আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ কম। পেটেন্ট সুবিধা হারালে আমাদের জন্য অনেক কিছুতে চ্যালেঞ্জ আসবে।
করসংক্রান্ত সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা এআইটি (অগ্রিম আয়কর) বাতিলের কথা বলেছিলাম। এটি ব্যবসায়ীদের মূলধন আটকিয়ে দেয়। কিন্তু সরকার কিছু পণ্যে ২০ শতাংশ এআইটি দিয়েছে। অনেক পণ্যে অ্যাডভান্স ভ্যাট রাখা হচ্ছে। এগুলো থেকে অব্যাহতি দিতে হবে।
করোনা সংকট মোকাবিলায় এসএমই খাতের জন্য বিশেষ বরাদ্দের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
ব্যক্তি বিনিয়োগ নিয়ে বিজিএমই সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমার কাছে মনে হয় ২০১৯-২০ সালে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বিশেষ করে করোনার সময়ে তো বিনিয়োগ হয়নি। এক্সপোর্ট কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রেমিটেন্স এসেছে এবং সরকারের প্রজেক্টগুলো চলেছে। ফলে অর্থনীতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও ব্যক্তি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সেভাবে হয়নি।
ইজ অব ডুয়িং বিজনেস নিয়ে সরকারকে আরও কাজ করার কথা বলেন তিনি। পাশাপাশি এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গার্মেন্টস খাতে নন-কটন ফাইবার আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছেন ফারুক হাসান।