বাংলাদেশে গণমাধ্যমের, বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের স্বাধীনতার সংকোচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে) বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডের গ্লোবাল কনফারেন্স গত ২ থেকে ৪ মে পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৮৬টি দেশের প্রায় এক হাজার অংশগ্রহণকারী বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য একত্রিত হন। তিন দিনের এই আয়োজনে অনলাইন এবং অফলাইনে ৬০টিরও বেশি সেশনে যোগ দিতে ৩ হাজার ৪০০ জন নিবন্ধন করেন।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে দুনিয়াজুড়ে কাজ করা পার্টনার এবং স্টেকহোল্ডারদের জন্য এই সম্মেলন একটি কার্যকরী প্ল্যাটফর্ম। ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান চিহ্নিত করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার ওপর নজরদারি বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট সমাধান তৈরি করা এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বক্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে সম্মেলনে আর্টিকেল নাইনটিন ‘ইক্যুয়ালি সেইফ: টুওয়ার্ডস অ্যা ফ্যামিনিস্ট অ্যাপ্রোচ টু দ্য সেফটি অব জার্নালিস্ট’- শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের আলোচনায় আর্টিকেল নাইনটিনের আমন্ত্রণে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, নারী কর্মীর নিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে গাইডলাইন না থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মিডিয়া হাউসে যখন কার্যকর ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতি’ থাকে না, তখন দায়মুক্তির সংস্কৃতি বেড়ে যায়। এজন্য সাংবাদিকদের আইনি সহায়তা প্রয়োজন; তবে কেবল ঐচ্ছিক সহায়তার (প্রো বোনো) ওপর সাংবাদিকরা নির্ভর করতে পারেন না। গণমাধ্যমগুলোতে সাংবাদিকদের জন্য আইনি সহায়তা একটি বাধ্যতামূলক সুবিধা হিসেবে প্রদান করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আর্টিকেল নাইনটিন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) প্রকাশিত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবনতিশীল অবস্থানের বিষয়ে সর্বোচ্চ উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২০২১ সালে ১৫২তম থেকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম হিসেবে বাংলাদেশের র্যাংকিং দেশটিকে এই অঞ্চলে ‘খুব খারাপ’ অবস্থানে রেখেছে। এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার চেয়েও পিছিয়ে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, এই বছর ইউনেস্কোর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ডিজিটাল অবরোধে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা’। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ উদাহরণগুলোর একটি। আর্টিকেল নাইনটিন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবনমনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই সূচকে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়েছে, যা দেশের জন্য বিব্রতকর।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট উভয়ের স্বাধীনতার জন্যই হুমকি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। একই পথ অনুসরণ করে এবার আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নতুন প্রবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
আর্টিকেল নাইনটিন সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম যোগাযোগকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সংস্থাটির বৈশ্বিক গবেষকদের তৈরি তিনটি ব্যবহারিক নির্দেশিকা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে। এগুলো হলো- সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগকারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নিরীক্ষণ এবং নথিভুক্ত করার জন্য একটি ইন্টারনেকশনাল জেন্ডার নির্দেশিকা, ইন্টারসেকশনাল জেন্ডার অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলাজনিত মামলার বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করা এবং সুরক্ষা প্রশিক্ষণের জন্য একটি ইন্টারসেকশনাল জেন্ডার গাইড।
আর্টিকেল নাইনটিন সরকারি সংস্থা, মিডিয়া হাউস এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বৈশ্বিক রেজুলেশন, ঘোষণা এবং প্রতিশ্রুতি মেনে চলার জন্য এবং সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের জন্য অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই একটি নিরাপদ এবং আরও সক্ষম পরিবেশ তৈরি করার আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের নির্ভরযোগ্য এবং জীবন রক্ষাকারী তথ্যের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানায়।