র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। শনিবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই প্রতিবাদ জানানো হয়। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের অসন্তোষের কথা জানান। শুক্রবার মার্কিন অর্থ ও পররাষ্ট্র দপ্তর র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত অপরিপক্ব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, দেশে কেউ ইচ্ছা করলেই ক্রসফায়ার দিতে পারে না। অপরদিকে বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
পররাষ্ট্র সচিব আরও জানান, সুনির্দিষ্ট যেসব অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেগুলো বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনার জবাবদিহির ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাখ্যা শুধু মার্কিন প্রশাসনের কাছেই নয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতায়ও আলোচনা হয়েছে। অথচ মার্কিন সিদ্ধান্ত কোনো যাচাই করা তথ্যের ভিত্তিতে নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার আইনের শাসন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো খারাপ কাজের প্রতি জিরো টলারেন্স বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে সব পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যের জন্য নির্ধারিত নিয়মকানুন রয়েছে। র্যাবও এমন নিয়মের বাইরে নয়।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। তার মানে এই নয় যে বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ কাজে সায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্টের নতুন একটা ঢং-পররাষ্ট্রমন্ত্রী : র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন একটা ঢং।
শনিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক আলোচনার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন। র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে কোনো অভিযোগ তথ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। ১০ বছরে ৬০০ লোক মারা গেছেন, তা ঢালাওভাবে বলা ঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যেখানে পরিপক্ব গণতন্ত্র রয়েছে, তাদের কাছ থেকে এমন ঢালাও অভিযোগ কাম্য নয়।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি তা মনে করি না। তবে এটা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মূল্যায়ন ছাড়াও কিছু এনজিও এবং মানবাধিকারগোষ্ঠী র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। কীভাবে তারা নিখোঁজ হয়, তা মার্কিন সরকার জানে না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় এক হাজার মানুষ পুলিশের হাতে মারা গেলেও কোনো সংস্থার প্রধানকে শাস্তি দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্র র্যাব সম্পর্কে যা বলেছে, তা বাস্তবতার ভিত্তিতে নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের বিশ্লেষণ আরও সুনির্দিষ্ট এবং আরও তথ্যভিত্তিক হওয়া উচিত।
দেশে কেউ ইচ্ছা করলেই কাউকে ক্রসফায়ার দিতে পারে না-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমাদের সিস্টেম খুবই সুন্দর। এ সিস্টেমে কেউ ইচ্ছা করলেই কাউকে ক্রসফায়ারে দিতে পারে না। ইচ্ছা করলেই কেউ কাউকে গুলি করতে পারেন না। সন্ত্রাসীরা যখন আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে, তখন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের জীবন রক্ষার্থে হয়তো অনেক সময় গুলি ছুড়ে থাকেন। সেটা তার জন্য বৈধ। আমাদের দেশে বন্দুকযুদ্ধের যত ঘটনা ঘটে, সব ঘটনারই একটি জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি হয়। খতিয়ে দেখা হয়, যে ঘটনা ঘটল এর পেছনে যথাযথ কারণ ছিল কি না, গাফিলতি ছিল কি না। কোথাও গাফিলতি পেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আর গাফিলতি না থাকলে সেখানেই ক্লোজড হয়ে যায়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। শনিবার এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকান সরকার একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এখনো আমার টেবিলে আসেনি। এটা আমাকে দেখতে হবে, কেন এবং কী কারণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। না দেখে পুরো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বিগত দিনে এসব ঘটনার পেছনে (ক্রসফায়ার) যথাযথ কারণ ছিল বলেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এসব ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমি তখন প্রতিমন্ত্রী। একটা ঘটনা ঘটেছিল ২০১৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রে একটি ছেলে ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে টিসু বের করতে পকেটে হাত দিয়েছিল। ঠিক তখনই তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এ ধরনের ঘটনা তো ওই দেশে ঘটেছে। অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আগে নিষেধাজ্ঞা কেন দিয়েছে, আমরা সেটা দেখব, দেখে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।’
সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইবে কমিশন : মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেছেন, সরকারের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হবে। এরপর যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, আমরা তাদের বক্তব্য নেব। এরপর গণমাধ্যমকে জানানো হবে। শনিবার যুগান্তরকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র?্যাবের সাবেক ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আলাদাভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গণমাধ্যমে দেখেছি। খোঁজ নিয়েছি, আমাদের এখানে অফিশিয়ালি এখনো আসেনি। এলে আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চাইব।
মানবাধিকার কর্মী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেডআই খান পান্না : এ বিষয়ে যুগান্তরের কাছে প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তারাই আবার নিষেধাজ্ঞা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোথাও হয়তো স্বার্থে আঘাত পড়েছে, সেজন্যই এই নিষেধাজ্ঞা। জেডআই খান বলেন, প্রথম কথা হলো, এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের রাষ্ট্রিয় ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এভাবে কিছু ব্যক্তির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে র্যাবের কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখ করে সরকারকে সতর্ক বা চিঠি দিতে পারত। আজ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কাল দেখবেন তা উঠিয়ে নিয়েছে। তাদের দেশে কালোদের ওপর কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, তা সারা পৃথিবীর মানুষ দেখছে। সেখানে কালোরা নিগৃহীত, তাদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। এখন আবার সেই দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে।