এমন সকাল কবারই-বা আসে দেশের ক্রিকেটে! যে সকালে লেখা হয় ইতিহাস। তাও যেনতেন নয়, ক্রিকেটের সবচেয়ে জৌলুশময় বনেদি ফরম্যাট টেস্টে। সেটাও আবার টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের ঘরের মাঠে। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ইতিহাস গড়ল টাইগাররা। সাদা পোশাকে রঙিন মুমিনুল হকের দল। সকালের রক্তিম সূর্য উকি দেওয়ার আগেই যে রঙ ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এ জয়টি যে বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল দেশের ক্রিকেটের জন্য।
ম্যাচের প্রথম ইনিংসে কিউইদের ৩২৮ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশ। পরে নিজেরা স্কোর বোর্ডে তোলে ৪৫৮ রান। এতে ১৩০ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে ব্ল্যাকক্যাপসরা। তবে টাইগার বোলারদের বোলিং তোপে সুবিধা করতে পারেনি স্বাগতিক শিবির। এবার অলআউট হয় ১৬৯ রানে। এতে ৪০ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায় বাংলাদেশের সামনে। ম্যাচের পঞ্চম ও শেষ দিনে সে লক্ষ্যে ৮ উইকেট হাতে রেখেই পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
১, ২, ৩ করে একে একে টানা ৩২ ম্যাচ হার। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত জয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ দল। নিউজিল্যান্ডে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে গিয়ে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৩২ ম্যাচের সবগুলোতে হার টাইগারদের। ৯ টেস্টে সাফল্য নেই একটিতেও। অবশেষে সে আক্ষেপ ঘুচেছে। নিউজিল্যান্ডে ইতিহাস গড়া জয় পেয়েছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচ জিতে নতুন বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল শুরু বাংলাদেশ দলের।
মাকড়সা নিয়ে এ গল্পটা আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। রবার্ট ব্রুস একাধিকবার স্কটিশদের ঐক্যবদ্ধ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু বার বার তিনি পরাজিত হতে থাকেন। একপর্যায়ে সবকিছু হারিয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে দেখেন একটি মাকড়সা প্রবল বাতাসের মুখে একশত বার চেষ্টা করার পর জাল বুনতে সক্ষম হলো। ক্ষুদ্র মাকড়সার জাল বোনা দেখে তিনি উপলব্ধি করেন, সফল হতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ দলকে অবশ্য শতবার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। তবে কাগজকলমের অপেক্ষার পালা নেহায়েত কমও যে নয়। ২১ বছর ধরে নিউজিল্যান্ডে সফর করা বাংলাদেশ দল অবশেষে জয়ের খোঁজ পেয়েছে। ২ ম্যাচ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে কিউইদের দেওয়া ৪০ রানের লক্ষ্য টপকে ৮ উইকেটে জিতেছে সফরকারীরা। এ জয়ের মধ্য দিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় চক্রে পয়েন্টের খাতা খুলল বাংলাদেশ।
ম্যাচের পঞ্চম ও শেষদিনে সকালেই প্রতিপক্ষকে অলআউট করে লক্ষ্য তাড়ায় নামে বাংলাদেশ। তবে ইনিংসের শুরুটা ভালো হয়নি সফরকারীদের। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ সাদমান ইসলাম প্রথম ইনিংসে ২২ রান করলেও এবার ফিরলেন ৩ রান করে। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে টিম সাউদির লাফিয়ে ওঠা বাইরে বলটি চাইলেই ছেড়ে দিতে পারতেন সাদমান, ঝুঁকি নিয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন।
ইনজুরিতে পড়া মাহমুদুল হাসান জয়ের পরিবর্তে তিন নম্বর থেকে আজ ইনিংস শুরু করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। সাদমানের আউটের পর শান্তও ফেরেন ১৭ রান করে। পরে অধিনায়ক মুমিনুল হক আর মুশফিকুর রহিম দলের জয়ের বাকি আনুষ্ঠানিকতা সারেন তিনি। ১৭ ওভার খেলে জয়ের বন্দরে পৌঁছায় বাংলাদেশ দল। বাকি থাকে আরও ২ সেশন। এতেই জয় আসে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
মুমিনুল ১৩ এবং মুশফিক ৫ রানে অপরাজিত থাকেন। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের সঙ্গে উপমহাদেশীয় কোনো দল ১০ বছর পর সেখানে টেস্ট জিতল।
এর আগে চতুর্থ দিনে ৫ উইকেট হারিয়ে কিউইদের সংগ্রহ ছিল ১৪৭ রান। ১৭ রানের লিড নিয়ে বুধবার ম্যাচের পঞ্চম ও শেষ দিন শুরু করেন অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান রস টেলর এবং রাচিন রবীন্দ্র। টেলর ৩৭ রান নিয়ে খেলতে নেমে এদিন সকালেই থামেন ব্যক্তিগত ৪০ রানে। ৬ রান নিয়ে ব্যাট করতে নামা রাচিন আউট হন ১৬ রান করে।
বাংলাদেশের হয়ে এবাদত হোসেন নেন ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৬ উইকেট। আগুনে বোলিংয়ে তাসকিনে দখলে ৩ উইকেট। ১ উইকেট নেন স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ।
দিনের দ্বিতীয় ওভারে নিজের প্রথম ওভার করতে আসেন এবাদত। দ্বিতীয় বলেই কিউই ব্যাটসম্যান রস টেলরকে বোল্ড করলেন এই ডানহাতি পেসার। এই উইকেট নিয়ে এবাদত ক্যারিয়ারে প্রথমবার পেলেন ৫ উইকেট। সঙ্গে প্রায় ৯ বছর পর বাংলাদেশের কোন পেসার ফাইফারের স্বাদ পেলেন। টেলরকে ফেরানোর পর এবাদত নিজের দ্বিতীয় ওভারে পান আরও একটি সাফল্য। এবার তার শিকার কাইল জেমিনসন। শরিফুল ইসলামের হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৮ বল খেলে রানের খাতা খুলতে পারেননি জেমিসন।
পরে দিনের পঞ্চম ও সপ্তম ওভারে তাসকিন তুলে নেন স্বাগতিকদের দুই ব্যাটসম্যানকে। তার প্রথম শিকার আগের দিনের অপরাজিত ব্যাটসম্যান রাচিন। তাকে বাধ্য করেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে। পরে তুলে নেন টিম সাউদির উইকেট। সরাসরি বোল্ড হয়ে সাউদি ফেরেন খালি হাতে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রেন্ট বোল্ড ৮ রান করে মিরাজের বলে আউট হলে ১৬৯ রানে থামে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস। জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়ে ৪০ রান। পরে ৮ উইকেট হাতে রেখে ইতিহাস গড়া জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এই জয় অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলের যে মানসিক অবস্থা, দেশের ক্রিকেটে যে গুমোট আবহাওয়া, সবকিছুর সমাধান কেবল মিলতে পারে মাঠের ক্রিকেটেই। হয়তো জয়ই এনে দিতে পারে সবকিছুর উত্তম সমাধান।