দেশে যেসব ট্রেন চলাচল করছে, সেগুলোর অধিকাংশের ইঞ্জিন-কোচ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। মাঝেমধ্যে এগুলো বিকল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। এগুলো সচল রাখতে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে দেশেই যন্ত্রাংশ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে রেল। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী মাসেই এ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। নতুন কিংবা আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন-কোচ মেরামতে আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের বিকল্প উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে এ নীতিমালা রেলওয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।
তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র রেলের ইঞ্জিন-কোচসহ যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। ইঞ্জিন-কোচ মেরামতে প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর থাকতে হয়। কখনো আবার যথাযথ সময়ে যন্ত্রাংশ ক্রয় করা সম্ভব হয় না। তাই ইঞ্জিন-কোচ সংস্কার সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। আবার কিছু যন্ত্রাংশ বিশ্ববাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ স্থানীয় প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো তৈরি করবে। এতে দেশেই স্বল্প দামে যন্ত্রাংশ মিলবে। এতে স্থানীয় শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে। আমরা দেশেই নতুন কোচ-ইঞ্জিন তৈরি করব।
রেলপধ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ইঞ্জিন-কোচ মেরামত এবং লাইন ও সিগন্যাল ব্যবস্থা ঠিক রাখতে প্রায় হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে রেলওয়ের নিজস্ব কারখানায় যন্ত্রাংশ তৈরি হবে। রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগ সূত্র জানায়, রেলের অনেক ইঞ্জিন-কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। সেগুলো এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ডেমু ট্রেনের আয়ুষ্কাল নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হতে চলেছে।
৬৫৪ কোটি টাকায় কেনা ২০টি ডেমু ট্রেনের মধ্যে বর্তমানে সচল আছে মাত্র তিনটি। ৩৫ বছর আয়ুষ্কাল থাকলেও ১ বছর যেতে না যেতেই নষ্ট হতে শুরু করে ডেমু ট্রেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অচল পড়ে থাকা ডেমু সেটগুলো মেরামত করতে হলে একমাত্র চীন থেকে যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে হবে। আর এই যন্ত্রাংশের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ এগুলো মেরামত করতে ক্রয়ের প্রায় সমপরিমাণ টাকা লাগবে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে ডেমুর অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া কিংবা নতুন ইঞ্জিন-কোচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত যন্ত্রাংশের দরকার হয়। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মজুত রাখতে হয়। অধিকাংশ ইঞ্জিন যন্ত্রাংশের কোনো ড্রয়িং-স্পেসিফিকেশন না থাকায় পার্ট নম্বর ও বিবরণের ভিত্তিতে চিহ্নিত করতে হয়। বিশ্বে এসব যন্ত্রাংশ বিলুপ্তির পথে। এগুলো বেশি অর্থ দিয়ে ক্রয় করতে হয় কেবল ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য।
পরনির্ভরশীলতা কমাতে অতীতে বিসিক নীতিমালার আওতায় এবং পরবর্তী রেলওয়ের মেকানিক্যাল শাখা থেকে জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী স্থানীয় প্রস্ততকারকদের সাময়িকভাবে যন্ত্রাংশ তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু যথাযথ মনিটরিং, নীতিমালা ও গাইডলাইন না থাকায় তা আলোর মুখ দেখেনি। কোনো শিল্পোদ্যোক্তাও এগিয়ে আসেনি। এখন শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ নিশ্চয়তা ও গুণগতমানের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নিশ্চয়তা রেখেই নীতিমালাটি হচ্ছে। নতুন নীতিমালার কারণে বছরের পর বছর উদ্যোক্তারা রেলওয়ের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের বিসিক তালিকাভুক্তির বা অনুরূপ অন্য কোনো সনদ, নিজস্ব কারখানা, পর্যাপ্ত মেশিনারিজ, দক্ষ জনবল ও আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, তারা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের জন্য যোগ্য হবেন। রেলওয়ে কর্তৃক গঠন করা ডকুমেন্ট অ্যাসেসমেন্ট কমিটি, ফ্যাক্টরি ইনস্পেকশন কমিটি, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও মূল্য নির্ধারণ কমিটি এসব বিষয় দেখাশোনা করবে।
এ ব্যাপারে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এ নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। দেশের অর্থ দেশে থাকবে, এগিয়ে যাবে রেল। রেলের ইঞ্জিনে ২৫ হাজার ধরনের যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয়। যন্ত্রাংশগুলো বিশেষ ‘আইটেম’। এসব আইটেমের মাত্র ৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়।
৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ বিভিন্ন বিদেশি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। আবার সময়মতো ক্রয় করাও সম্ভব হয় না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় ইঞ্জিনের যথাযথ মেরামতও হয় না। হিমশিম খেতে হয় ট্রেন পরিচালনায়। আমরা এ নীতিমালা চূড়ান্তের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে চাই। আগামী নভেম্বরে পাহাড়তলী কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ এলাকায় সেমিনার, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের প্রদর্শনীসহ স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে দুই দিনব্যাপী বিশেষ প্রোগ্রাম করব।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। রেল শুধু আমদানিনির্ভর হতে পারে না। আমাদের রেলেও দক্ষ শ্রমিক রয়েছে। দেশেই নতুন ইঞ্জিনসহ অধিকাংশ যন্ত্রাংশ তৈরি করা হবে। যে হারে রেলে উন্নয়ন হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় যন্ত্রাংশের চাহিদাও ব্যাপক বাড়বে। নীতিমালা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেশের মাটিতে উৎপাদন সম্ভব হলে রেলে সেবা দারুণভাবে বাড়বে। সর্বোচ্চ সংখ্যক লোকোমোটিভের যন্ত্রাংশ দেশে তৈরির সুযোগ সৃষ্টি, রেলে যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেকসই উদ্যোক্তা তৈরিসহ সাতটি উদ্দেশ্য রয়েছে খসড়া নীতিমালায়, যা দেশ ও রেলের কল্যাণ বয়ে আনবে। রেলপথ সচিব সেলিম রেজা বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত হলে দেশেই নতুন কোচ তৈরি করা হবে। ইঞ্জিন মেরামত করতে আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। যন্ত্রাংশ তৈরি-উৎপাদনে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশে থাকবে রেল।