পঁচাত্তর বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা ভুঁইয়া। করোনা মহামারীর কারণে কর্মহীন হয়ে ক্ষুধার তাড়নায় তিনি ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিচু কাজ করতেও বাধ্য হন। ৭১-এর রণাঙ্গনের বীর সৈনিক মোস্তফা ভূইয়া ৭৫ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ জীবনে এসেও তার কাঁধে সংসারের বোঝা। স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেও নানা প্রতিবন্ধকতায় রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়ায়নি একদিনের জন্যও। ফলে অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করে চলা বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই তেজস্বী মানুষটি গভীর সাগরে জেলেদের সঙ্গে কাজ করে টানছেন সংসারের ঘানি।
দেশের এই সূর্য সন্তান প্রতিদিনের সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যতক্ষণ দম আছে জীবিকার তাগিদে হালাল রুজির চেষ্টার লড়াই করেই যামু ইনশাআল্লাহ। চোখের পানি ফেলে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কিছু পাইনি। পাইছি খালি অবহেলা, আর অবনতি। শরীর সুস্থ থাকলে দুইবেলা খাইয়া বাইচা থাহার জন্য মাছের ট্রলারে গভীর সাগরে যাই। আর যহন অসুস্থবোধ করি তহন মানুষের কাছে হাত পাইতা চলতে হয়। কখনো না খাইয়াও থাকতে হয়।
পটুয়াখালী কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হলদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা ভূইয়া। ১৯৭১ সালে জুলাই মাসে ভারতের বগাপাড় ট্রেইনিং সেন্টারে বন্দুক ও বোমার উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে চলে এসে যোগ দেন নোয়াখালীর ১ নং সেক্টরে। মেজর রফিকুল ইসলামের অধীনে ৩ মাস পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর চলে যান চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একপর্যায়ে পাহাড় থেকে পড়ে বাম পায় আঘাত পেয়ে আহত হন।
দেশ স্বাধীনের পর চলে আসেন তখনকার নিজ এলাকা সন্দীপ উপজেলার কাঠগোড় ইউনিয়নে। প্রায় ২০ বছর আগে নদী ভাঙনে সব কিছু হারিয়ে চলে আসেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ৭৫ বছর বয়সী এই বীর সেনা।
দেশ স্বাধীনের পেছনে মোস্তফা ভূইয়ার যে অবদান রয়েছে তার স্বীকৃতি সরকার না দিলেও, কলাপাড়াবাসী এবং তার সহযোদ্ধারা দিয়েছেন। কলাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্যরা তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা ভূইয়া নামেই চিনেন।
পটুয়াখালীর প্রাক্তন জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন মধু বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যত ধরনের প্রমাণ থাকা দরকার মোস্তফা ভূইয়ার সব আছে। কলাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ বাংলাদেশে যদি একজন মুক্তিযোদ্ধার গেজেট দিতে হয়, আমরা মনে করি তা দেওয়া উচিৎ মোস্তফা ভূইয়াকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ রানা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, খবরের কাগজে যখন দেখি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়, কিন্তু মোস্তফা ভূইয়া সত্যিকারের যোদ্ধা হয়েও সম্মান পান না, এর চেয়ে লজ্জা আর থাকে না। এই বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ মোস্তফা ভূইয়া বেঁচে থাকার যে লড়াই করে যাচ্ছেন তা সহ্য করার নয়। সরকারি উদ্যোগে তার চিকিৎসাসহ দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মোস্তফা ভূইয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কলাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির পক্ষ থেকে ওনার নাম সহ একটি তালিকা মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়েছে। মোস্তফা ভূইয়া মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা চেষ্টা করছি, ওনাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার। ইতোমধ্যে একটা ঘর দিয়েছি। এরপর একটা সবজির দোকান দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এলাকাবাসী বলছেন, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়। যেদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশপ্রেমী এসব মুক্তিযোদ্ধাদের, জেগে উঠবে না আর চিরনিদ্রায় শায়িত মুক্তি যোদ্ধারা এ বাংলায়।