রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গুলশান থানায় দায়েরকৃত মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই তরুণীর নাম মোসারাত জাহান মুনিয়া। সে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসির শিক্ষার্থী। মোসারাতের বড় বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। এর প্রেক্ষিতে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুলিশের করা আবেদন মঞ্জুর করেন। ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গুলশান থানার নিবন্ধন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন এ তথ্য জানান।
ডিসি গুলশান (ক্রাইম ডিভিশন) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, গত সোমবার দিবাগত রাতে গুলশান ২ নম্বরের ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান। বাড়ি কুমিল্লার উজির দিঘিরপাড়। এক লাখ টাকা ভাড়ায় মাস দুয়েক আগে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন মোসারাত। ঠিক কী কারণে তরুণী আত্মহত্যা করলেন, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। লাশ সউদ্ধারের পর পরই বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।
ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গুলশান থানার নিবন্ধন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করেছিলেন গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল হাসান। আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন। সেই সঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন সায়েম সোবহান আনভীর যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন। এদিকে মামলার এজাহারে বড় বোন নুসরাত জাহান উল্লেখ করেছেন, আমার বোন মোসারাত মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসির শিক্ষার্থী। দুই বছর আগে আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে বোনের পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে তারা দেখা করতো এবং মোবাইল ফোনে কথা বলতো। এক পর্যায়ে আমার বোন মুনিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার।
২০১৯ সালে উক্ত আসামি আমার বোনকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আসামির পরিবার মুনিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পারে। পরে পিয়াসা নামে এক নারীর মাধ্যমে আনভীরের মা মুনিয়াকে ডেকে নিয়ে ভয়ভীতি দেখায় এবং ঢাকা থেকে চলে যেতে বলে।
মামলার এজাহারে তিনি আরো বলেছেন, এ ঘটনার পর আসামি আমার বোনকে বিয়ে করবে বলে আশ্বাস দিয়ে কৌশলে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। সর্বশেষে মুনিয়াকে গত ১ মার্চ আসামি সায়েম সোবহান আনভীর প্ররোচিত করে আমার এবং আমার স্বামীর এনআইডি কার্ড দিয়ে বাসা ভাড়া নিতে বলে। কুমিল্লা থেকে ফুসলিয়ে মুনিয়াকে নিয়ে এসে গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার বি/৩ ফ্যাটটি ভাড়া নেয় আসামি। ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি সায়েম সোবহান আনভীর ও মুনিয়ার ছবি বাঁধিয়ে রাখে। এমনভাবে রাখে যেন তাদের ছবি দেখলে মনে হয় তারা স্বামী-স্ত্রী। আনভীর এলে ওই কক্ষটিতে থাকতো।
এজাহারে বলা হয়েছে, আমার বোনের মাধ্যমে আমি জানতে পারি আসামি আনভীর মুনিয়াকে বিয়ে করে দেশের বাইরে সেটেল করবে। কারণ, বাংলাদেশে যদি আসামির বাবা-মা মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পারে তাহলে আনভীরকে কিছু করবে না। মুনিয়াকেই মেরে ফেলবে।
মামলায় বলা হয়, গত ১ মার্চ থেকে আসামি সায়েম সোবহান আনভীর আমার বোন মুনিয়াকে গুলশানের ফ্ল্যাটে রাখে। সে মাঝে মাঝে ওই ফ্ল্যাটে স্বামীর মতো আসা যাওয়া করতো। গত শুক্রবার আমার বোন ফোন করে জানায়, আনভীর তাকে বকা দেয়, কেন সে ফ্ল্যাট মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করে এবং ছবি তোলে। কারণ জানতে চাইলে আনভীর বলে ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছে। এটা পিয়াসা দেখেছে। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক ফ্রেন্ড এবং পরিচিত ছিলেন। পিয়াসা তার মাকে সব জানিয়ে দেবে বলে আনভীর জানায়। এছাড়া আনভীর মোসারাতকে বলে তোমার আর এখানে থাকার দরকার নেই। তুমি কুমিল্লায় চলে যাও। আমি দুবাই চলে যাচ্ছি। কারণ, আম্মা জানতে পারলে তোমাকে মেরে ফেলবে।
বড় বোন নুসরাত মামলায় উল্লেখ করেন, গত ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে মুনিয়া তার মোবাইল নম্বর থেকে আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করে বলে আমাকে আনভীর বিয়ে করবে না। আনভীর মুনিয়াকে জাস্ট ভোগ করেছে এবং বলেছে তুই আমার শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিস। মনে রাখিস তোকে আমি ছাড়বো না। আমাকে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলে। যেকোনও সময় আমার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তোমরা তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসো।
নুসরাত সাংবাদিকদের বলেন, আমি এলাকার মামাতো বোন ইভা ও ফুফাতো ভাই ইকবালকে নিয়ে সোমবার দুপুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। আসার পথে মুনিয়ার ফোনে অসংখ্যবার যোগাযোগ করি। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। বিকালে বাসায় পৌঁছে দরজা নক করলে ভেতর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে নিচে নেমে সিকিউরিটি গার্ডের রুম থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করি। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন করলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার পরামর্শ দেন।
পরে ওই বিল্ডিংয়ের ম্যানেজারকে দিয়ে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ভেতরে মুনিয়াকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলে থাকতে দেখি। মুনিয়ার পা খাটের সঙ্গে লাগানো ছিল। পরে ম্যানেজার বিষয়টি পুলিশকে জানায়। পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে এবং বাসা থেকে মুনিয়া ও আনভীরের একাধিক ছবি ও মোবাইল ফোন আলামত হিসেবে জব্দ করে। সে সঙ্গে মুনিয়ার ডাইরি নিয়ে যায়। ডাইরিতে সে তার সমস্ত কথা লিখে রাখত।