‘ছোট মেয়েটার বয়স তিন বছর। মেয়েটার কাছে থাকাই হয় না। মেয়েটা বাবাকে চেনে শুধু ভিডিও কলে দেখে। ফোন রাখার পর যে কতদিন কেঁদেছি তার হিসাব নাই।’- এভাবে দুঃখের কথাগুলো বলছিলেন শিক্ষক নাজির হোসেন। তার পরিবার থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু চাকরির জন্য তাকে থাকতে হয় পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলায়।
নাজির হোসেন বলেন, ‘বাড়িতে যখন যাই, আসার সময় ছেলেমেয়েরা বলে, বাবা তুমি চলে যাবে? এই কথা শোনার পর আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। আবার পরিবার থেকে দূরে থেকেও পর্যাপ্ত অর্থ বাড়িতে পাঠাতে পারি না। তখন খুব অসহায় লাগে নিজেকে।’
চংড়াছড়ি এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তিনি। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) প্রথম পরীক্ষায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমরা ঐচ্ছিক বদলি চাই। এই স্বল্প বেতনে চাকরি করি, আবার বাড়ি থেকে এত দূরে চাকরি করা যায় না। তাই আমাদের এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বদলি কার্যক্রম চাই। নিজ নিজ এলাকায় বা কাছাকাছি স্থানে আমাদের বদলি চাই।’
নাজিরের মতো দুঃখ দুর্দশা নিয়ে চাকরি করছেন হাজারো শিক্ষক। বেসরকারি এমপিএওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি- বদলি প্রথা চালু না হওয়ায় ভেঙে পড়ছেন তারা।
শিক্ষকরা জানান, বদলি কার্যক্রম চালু না থাকায় প্রথমত শিক্ষকরা আনন্দের সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত স্বল্প বেতনে বাড়ি থেকে দূরে চাকরি করায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে নানা জটিলতা ও অশান্তি। আবার অনেক শিক্ষক ভিন্ন এলাকায় চাকরি করায় প্রভাবশালীদের নানা চাপের মুখেও নথি স্বীকার করতে হচ্ছে।
নাজিরের মতো আরেক শিক্ষকের নাম ইমাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি নীলফামারীর ডোমার উপজেলায়। আমার স্কুল পটুয়াখালীতে। দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে হয়। এতটাই দূরের পথ যে, বাসে করে যেতেই আমার ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। ২০১৬ সালে চাকরিতে যোগদান করি। আমি অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে পারি না। তিনি খুবই অসুস্থ। মায়ের খরচ দিতে হয় তিন থেকে চার হাজার টাকা। আমরা মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকায় জয়েন করেছি। এই অর্থে আসলে এলাকা ছেড়ে থাকাটা খুবই কষ্টকর। একবার বাড়ি গেলে অন্তত আমার ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এত টাকা খরচ করাও সম্ভব হয় না।’
শান্তনু মৈত্রর কষ্টটা আরও বেশি। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে টাঙ্গাইল থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন মৌলভীবাজারে। তিনি বলেন, ‘মা অসুস্থ ছিল অনেক দিন ধরেই। ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারিনি, কারণ আমার হাতে টাকা ছিল না। এভাবে কয়েক দিন যায়। মায়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি শুধু। এরপর মা যখন খুবই অসুস্থ হলেন তখন টাকা ধার করে রাতে রওয়ানা দিই। কিন্তু মা রাতেই মারা যান। জীবিত অবস্থায় আমি শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি মাকে। অর্থের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাটাও করাতে পারিনি।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘বাড়িতে যাবার পর সবাই আমাকে ভুল বোঝে- মা অসুস্থ হওয়ার পরও আমি দেখতে আসিনি। কিন্তু আমি জানি আমার অবস্থা। সেসময় এমন একটা অবস্থা ছিল যে টাকা ধার পর্যন্ত করতে পারছিলাম না। শিক্ষা লাভ করে শিক্ষক হলাম। এখন এমন অবস্থা না চলছে সংসার, না রক্ষা করতে পারছি সামাজিকতা। স্ত্রী, সন্তানকেও আনতে পারছি না। কারণ বাড়ি ভাড়া করে চলার মতো আমার আয় নাই।’
বেসরকারি এই শিক্ষকদের বদলি না হওয়ায় এমন সমস্যা যেন সিংহভাগেরই। দীর্ঘদিন ধরেই বদলি কার্যক্রমের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এমনকি দ্বারস্থ হয়েছিলেন আদালতেরও। সাইফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, ‘দাবি আদায়ে আমরা আদালতে গিয়েছিলাম। আমাদের পক্ষে রায় এসেছিল। কিন্তু এরপরও কোনো অগ্রগতি নেই।’
২০২১ সালে ১৩০ শিক্ষকের দায়ের করা রিটের বিপরীতে বদলির বিষয়ে পদক্ষেপের ওপর জোর দেন আদালত। এতে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে পারবে।
২০২১ সালে ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলির ব্যবস্থা রেখে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ জারি করে। এতে বলা হয়, এনটিআরসিএ এর সুপারিশে নিয়োগ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠান শূন্যপদ থাকাসাপেক্ষে সমপদে ও সম স্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই কার্যক্রমটি থমকে থাকার পেছনেও বেশকিছু কারণ আছে। যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র, আলাদা ধরন ও মানের পরিবর্তন থাকায় এটি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েও সুফল আসেনি। এছাড়াও পরিচালনা কমিটি আলাদা শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগে ভিন্নতা, বেতনভাতা ও পদোন্নতি নিয়েও আলোচনার টেবিলে জটিলতা দেখা দেয়। এরপর করোনার কারণে এতে চলে আসে ধীরগতি। খাতা-কলমে ও টেবিলের দ্বিমতের কারণে শিক্ষকদের দুঃখগাথা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
এ সমস্যা থেকে সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলেন রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রতিবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। বিদ্যমান নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত উভয় প্রকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান শূন্য আসনে নতুন নিয়োগের পূর্বে স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন চেয়ে এনটিআরসিএ প্রয়োজনমতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমপদে ও একই বিষয়ে কর্মরত সমঅভিজ্ঞ ইনডেক্সধারী আগ্রহী শিক্ষকদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে পছন্দক্রম দিয়ে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
এই শিক্ষক বলেন, একই প্রতিষ্ঠানের একই বিষয়ে ও পদে একাধিক আবেদনকারীর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আইসিটি জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা, চারিত্রিক গুণাবলি, সহশিক্ষা ইত্যাদির সঙ্গে দূরত্ব বা জেলা ও উপজেলা কোটা বিবেচনা করে অধিক পয়েন্টপ্রাপ্ত শিক্ষককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এভাবে বদলি কার্যকর হওয়ার পর যেসব প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ সৃষ্টি হবে সেগুলোতে বিধি মোতাবেক নতুন নিয়োগ দিলে কমবে শূন্যপদ নির্ধারণের জটিলতা।
এনটিআরসিএ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের বদলি নিয়ে আমরা কাজ শুরুর করব। তারা যেন বদলি হয়ে নিজ বাড়ির কাছে আসতে পারেন সেজন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। অনেকেই নিজ বাড়ি থেকে অনেক দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তবে আমাদের এটিও দেখতে হবে- বদলি চালু হলে হাওর এলাকা, পার্বত্য অঞ্চলসহ পিছিয়ে থাকা জায়গাগুলোতে শিক্ষক সংকট দেখা দেবে। এই অঞ্চলগুলো দুর্গম হওয়ায় শিক্ষকরা এখানে থাকতে চাইবেন না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন হওয়া অনেক জটিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি হলে তখন তা বাস্তবায়নের কাজ করবে মাউশি।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফৌজিয়া জাফরীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। আশা করছি শিক্ষকরা খুব শিগগিরই সুফল পাবেন।’