• তিন বছরে ওভারটাইম হিসেবে খরচ ১৬২ কোটি টাকার বেশি
• আইন অনুযায়ী ওভারটাইমে দ্বিগুণ অর্থ, তবে অবশ্যই মূল বেতনের বেশি নয়
• পত্রিকা বিল ও সম্মানী ভাতাসহ অন্যান্য খাতের হিসাবেও গরমিল
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, দৈনিক ৮ ঘণ্টা, সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা ও মাস হিসেবে গড়ে ১৭৫ ঘণ্টা কর্ম-সময় ধরা হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কাজকে ওভারটাইম বলা হয়। যদিও ওভারটাইমসহ সর্বোচ্চ কাজের সময় সাপ্তাহিক ৬০ ঘণ্টা এবং বছরে সাপ্তাহিক ৫৬ ঘণ্টার বেশি হতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, সাধারণ কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজের জন্য মূল বেতনের দ্বিগুণ অর্থ পাবেন। তবে মাস শেষে ওভারটাইম মূল বেতনের বেশি হতে পারবে না।
কিন্তু ঢাকা ওয়াসায় ঘটেছে এর উল্টো ঘটনা। গত তিন বছরে ১৬২ কোটি টাকার বেশি ওভারটাইম হিসেবে খরচ করা হয়েছে। আড়াই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেওয়া ওভারটাইম মূল বেতনকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে! কেবল ওভারটাইমই নয়, পত্রিকা বিল, বিভিন্ন অ্যালাউন্স, কম্পিউটার মেইনটেন্যান্স ও সম্মানী ভাতা বাবদ লাখ লাখ টাকা বিল দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওভারটাইমসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দেওয়ার এমন একটি অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মাঠেও নেমেছে দুদকের বিশেষ টিম।
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওয়াসার কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান রয়েছে। তবে আপনার উল্লেখ করা ওই অভিযোগের অনুসন্ধানের বিষয়টি আমারা জানা নেই।
ওভারটাইমের সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ডিএমডি (অর্থ) মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ প্রতিষ্ঠানে নতুন। আপনি যে বছরগুলোর বিষয়ে জানতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে জানতে আপনি জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করুন।
অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তফা তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি জেনে জানানোর কথা বলেছেন।
ওভারটাইমের বিষয়ে যা আছে শ্রম আইনে
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর নবম অধ্যায়ে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ও ওভারটাইমের বিষয়ে বলা আছে, সাধারণত দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা কর্ম সময় ধরা হয়। বিশ্রাম এবং খাবার সময় ব্যতীত যে পরিমাণ সময় শ্রমিকরা তাদের নিয়োগকর্তার অধীনে কাজের জন্য দিয়ে থাকেন সেই সময়কে ‘কর্ম সময়’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, যদি কোনো শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন তাহলে তাকে ওভারটাইম হিসেবে ধরা হয়। ওভারটাইমসহ সর্বোচ্চ কাজের সময় সাপ্তাহিক ৬০ ঘণ্টা এবং বার্ষিক গড়ে ৫৬ ঘণ্টার বেশি হতে পারবে না। এই শর্ত অনুযায়ী সর্বোচ্চ ওভারটাইম দৈনিক ২ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ১২ ঘণ্টা হয়ে থাকে। তবে এক বছরে ওভারটাইমের পরিমাণ গড়ে সপ্তাহ প্রতি ৮ ঘণ্টা অতিক্রম করতে পারবে না। শ্রম আইন অনুযায়ী, সাধারণ কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজের জন্য মূল বেতনের দ্বিগুণ অর্থ পাবেন। তবে আবার মাস শেষে ওভারটাইম মূল বেতনের বেশি হতে পারবে না।
অডিট রিপোর্ট ও অভিযোগ কী বলছে
ঢাকা ওয়াসায় বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন প্রায় ৫ হাজার। যার মধ্যে স্থায়ী জনবলের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। বাকিরা অস্থায়ী (চুক্তিভিত্তিক ও আউটসোর্সিং)। স্থায়ী জনবল নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ টাকা ওভারটাইম হিসেবে নেন।
মন্ত্রণালয়ের অডিট প্রতিবেদন ও দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে ওয়াসার অভ্যন্তরীণ অডিট অনুযায়ী তিন বছরে ১৬২ কোটি টাকার বেশি ওভারটাইম হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ওভারটাইম বাবদ খরচ হয়েছে ৭৭ কোটি, ২০২০ সালে ৪২ কোটি ও ২০২১ সালে ৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। কেবল ওভারটাইমই নয়, ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তার রুমে যে পত্রিকা রাখা হয়, তার বিল বাবদও কয়েক লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতন থেকেও ওভারটাইমের টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন অ্যালাউন্স, কম্পিউটার মেইনটেন্যান্স ও সম্মানী ভাতা। বিপুল টাকা খরচ করা হয়েছে বিভিন্ন অ্যালাউন্স ও সুযোগ-সুবিধা নেওয়া বাবদও।
ওয়াসার ২০১৯ সালের অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন বাবদ খরচ হয়েছে ৭১ কোটি টাকা। তবে ওভারটাইম হিসেবে খরচ হয়েছে তার চেয়েও বেশি। যার পরিমাণ ৭৭ কোটি টাকারও বেশি। একই বছরে দৈনিকভিত্তিতে শ্রমিকদের মজুরি ২০ কোটি ৩৬ লাখ, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে ৩ কোটি, বিজ্ঞাপন বাবদ ২ কোটি ৯১ লাখ, অফিস মেইনটেন্যান্স ১ কোটি ৬২ লাখ, অফিস ফার্নিচার মেইনটেন্যান্স বাবদ ৩ লাখ ৬৭ হাজার, কম্পিউটার মেইনটেন্যান্স ১৮ লাখ এবং সম্মানী-ভাতা বাবদ ৮৭ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়াও রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট বাবদ প্রায় ৭ কোটি, কনসালট্যান্ট ফি বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। সংবাদপত্র বিল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ২০২০ সালের অডিটের নথি অনুযায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন হিসেবে খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি টাকা, আর ওভারটাইম হিসেবে খরচ দেখানো হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। একই বছরে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে শ্রমিকদের বেতন ছিল ৪৩ কোটি টাকা। অথচ ২০১৯ সালে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে শ্রমিকদের বেতন ছিল ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি খরচ হয়েছে দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেছনে। যেখানে বড় অংকের গরমিল রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বাবদ আরও প্রায় ১ কোটি খরচ হয়েছে। বিস্ময়করভাবে খরচ দেখানো হয়েছে সংবাদপত্রের বিল দেখানোর ক্ষেত্রেও। ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে সংবাদপত্র বিলে। এর বাইরেও যানবাহন মেইনটেন্যান্স ২ কোটি ৭৯ লাখ, বিজ্ঞাপন বাবদ ২ কোটি ১৯ হাজার, অফিস মেইনটেন্যান্স ২ কোটি ৬৯ লাখ, অফিস ফার্নিচার মেইনটেন্যান্স বাবদ ৪ লাখ ১৮ হাজার, সম্মানীভাতা প্রায় ১ কোটি, কম্পিউটার মেইনটেন্যান্স ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২১ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ওই বছর ওভারটাইম বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কর্মচারীদের বিল বাবদ ব্যয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যদিও তা আগের বছর ছিল ২০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়াও নাইট অ্যালাউন্স বাবদ ১২ লাখ ৫৯ হাজার, কনভেন্স বাবদ খরচ ২ কোটি ৮৯ লাখ, বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ ৩ কোটি ৮৬ লাখ, অফিস মেইনটেন্যান্স বাবদ ৩ কোটি ৭৮ লাখ, অফিস ফার্নিচার মেইনটেন্যান্স ৫ লাখ ৫৩ হাজার, প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারি ১ কোটি ৮৪ লাখ, বিনোদন বাবদ খরচ হয়েছে ৯৮ লাখ ৭৪ হাজার, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বাবদ ১ কোটি ৫৩ লাখ, সম্মানীভাতা বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ, কম্পিউটার মেইনটেন্যান্স বাবদ খরচ ২৪ লাখ ৫৪ হাজার। সংবাদপত্রের বিল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে দেড় লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওভারটাইম, সংবাদপত্রের বিল, সম্মানিভাতা, অফিস খরচের নামে ওয়াসায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনেক বছর ধরেই আছে। অবাক করা বিষয় হলো সংবাদপত্রের বিল! প্রথম শ্রেণির কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া বাকিদের সংবাদপত্র পাওয়ার কথা নয়, এতো বিল কী করে আসে? জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ তাদের জন্য ঢাকা ওয়াসার সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনারাও অনেক লিখলেন, প্রতিকার কিছু হলো? বলে আর কী লাভ?
ওয়াসার এমডিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আরও দুর্নীতির অনুসন্ধান
প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট (পিপিআই) কার্যক্রমের ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ওয়াসার তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১০ মে মামলা করে দুদক। যেখানে ঢাকা ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান, ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই পরিচালনা পর্ষদের মো. হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া এবং ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন ৬-এর কম্পিউটার অপারেটর মো. নাঈমুল হাসানকে আসামি করা হয়েছে।
ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী পিপিআই কার্যক্রমে কমিশন হিসেবে ৩৫৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। কমিশন বা লভ্যাংশ হিসেবে ওই টাকা জমা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মিলেমিশে ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন। মামলার তদন্ত বর্তমানে চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে ১৪টি বাড়ির মালিকসহ বিভিন্ন অভিযোগে পৃথক আরও একটি অনুসন্ধান দুদকে চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।