দেশে সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্নভাবে আহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। দুর্ঘটনা পরবর্তী ৬ ঘণ্টা রোগীর জন্য গোল্ডেন আওয়ার। এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় অধিকাংশ রোগী যথাসময়ে সেবা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে বছরে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করছেন। দেশে প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ পঙ্গু হচ্ছেন, তার একটা বড় অংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। আর শিশুদের একটা বড় অংশ ছাদ বা গাছ কিংবা অন্যান্য জায়গা থেকে পড়ে পঙ্গু হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার (১৫ মার্চ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পঙ্গু দিবস’।
কিশোরগঞ্জের হোসেন্দী এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। তিনি পেশায় একজন পুলিশ সদস্য। গত ৩ মার্চ কাঁচপুর মহাসড়কে ডিউটিরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গোড়ালিতে চোট পান তিনি। এরপর চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)।
আলমগীরের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। হাসপাতালে খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ভর্তির টিকিট ১৫ টাকা আর বিছানা ভাড়া ফি। বাকি সব নিজেদের কিনতে হচ্ছে। প্রতিদিন চারবার ইনজেকশন সঙ্গে ওষুধ কিনে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। সার্জারির জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। চিকিৎসা করতে গিয়ে এখন বাধ্য হয়ে ঋণ করছি।
পঙ্গু হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০২২ সালে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩২৪ জন। জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬২ হাজার ৭১০ জন। ভর্তি হয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭১ জন। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৬৯৫ জনের এবং মারা গেছেন ৭ হাজার ৩৩৮ জন। অন্যদিকে চলতি বছর জানুয়ারিতে হাসপাতালটিতে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ১৯৭ জন, ভর্তি ২ হাজার ৩৯৭ জন। ফেব্রুয়ারিতে জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৩০৮ জন এবং ভর্তি হয়েছেন ২২৭৫ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পঙ্গু হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, এখানকার জরুরি বিভাগে চারটি অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয়তলায় একটি ইনফেকশনজনিত ডার্টি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) এবং দুটি রুটিন অস্ত্রোপচার কক্ষসহ মোট ৫টি ওটি কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব ওটিতে দৈনিক গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০টির মতো অস্ত্রোপচার হচ্ছে।
বর্হিবিভাগের চিকিৎসক সৈয়দ মোহাম্মাদ সরোয়ার বলেন, বর্হিবিভাগের ১২টি কক্ষে দৈনিক গড়ে ১৫০ রোগী আসে। যারমধ্যে ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসে। যাদের মধ্যে গড়ে ৭ থেকে ১০ জনই একেবারেই পঙ্গুত্বের শিকার হওয়ার মত পরিস্থিতি নিয়ে আসে।
অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব ও পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হয়। রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া, হাড় ভাঙা, ওপেন ফ্র্যাকচার ও ইনফেকশনের চিকিৎসায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে সেবা দিতে হয়। এতে প্রাণ বাঁচানোসহ পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু ঢাকার বাইরে নিটোরের মতো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অধিকাংশ আহতরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। বিশেষায়িত সেবা নিতে ব্যর্থ হন।
অন্যদিকে, বেড়েছে আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম, আগারগাও এলাকায় অর্থোপেডিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি করেন এমন কয়েকটি দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাইপোলার হিপ সার্জিক্যালের দাম ৬ হাজার ৫০ টাকা থেকে ৭ হাজার ৫০ টাকা, মডুলার বাইপোলার ৪০ হাজার থেকে বেড়ে ৪৫ হাজার হয়েছে। অস্টিওটমিজের সার্জিক্যালের দাম ২৫’শ টাকা থেকে বেড়ে ২৭’শ টাকা হয়েছে। পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতায় ব্যথা ব্যবহৃত ভারতীয় টাইনর কোম্পানির ‘ফুট ড্রপ ৭০০ টাকা বেড়ে হয়ে এক হাজার টাকা, ঘাড় ব্যথায় সার্ভাইক্যাল কলার ২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা।হাঁটুর টুপি বা নি-ক্যাপের দাম ২১০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫০ টাকা, নি-ব্যাচ বা হাঁটুর বন্ধনীর দাম ১৮০০ টাকা থেকে দাম বেড়ে ২৬০০ টাকা হয়েছে। হাঁটার ওয়াকিং স্টিক তিন মাস আগে ৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৬০০ টাকা।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুর্ঘটনার শিকার একজন রোগীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যান্ডেজের গজ কাপড়, প্লাস্টার থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে। বিশেষ করে, বড় সাজারি করতে গেলে রোগীর পরিবার খরচ সামলাতে পারেন না। তাদের পায়ের গোড়ালি, হাটুতে বা হিপে প্রতিস্থাপন সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়। যেগুলোর দাম ২০ শতাংশ নিচে কোনোটায় বাড়েনি। যা একজন মধ্য আয়ের মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য। আর এভাবে সব চিকিৎসা ব্যয় বাড়তে থাকলে দেশে পঙ্গুত্বে হার আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, মহাসড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিতে ২০১০ সালে ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ৬টি ট্রমা সেন্টার স্থাপন করা হয়। সেগুলো কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম অবস্থিত। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেন্টারগুলোতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক (অ্যানেসথেসিস্ট), নার্স, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রোপচার কক্ষ, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) তীব্র সংকট রয়েছে। এতে তাৎক্ষণিক সেবাদান সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালের আগে পঙ্গু হাসপাতালে ১২টা আইসিইউ ছিল। এখন একটিও নেই। রোগীদের প্রয়োজন হলেও সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভাস্কুলার সার্জন ও অ্যানেসথিয়েস্টি চিকিৎসকেরও ঘাটতি রয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে করা তাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে পঙ্গু ভিক্ষুকদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনার শিকার। এছাড়া হতাহত ব্যক্তিদের বড় অংশ কর্মক্ষম। কিন্তু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে পঙ্গু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোগে উদাসিনতা দেখা যায়। এ দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী হচ্ছে না।