বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার খেউনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। কারণ তাদের বাড়ি এমনভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে, যা একেবারে বসবাসের অযোগ্য। পরিবারগুলোর কারো বাড়িতে এখন নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, নেই বৈদ্যুতিক সংযোগও। আসবাব তো নেই-ই, এমনকি রান্নার চুলাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাড়িতে থাকা খাদ্যদ্রব্য, অলংকারসহ গরু-ছাগল সব লুট করে নেওয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যালয়ে থাকলেও তাদের খাবার সংস্থান করছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। এক মাস আট দিন পলাতক থাকার পর বাড়ি ফিরে এই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা দেখেন সব কিছু ভাঙা। এরই মধ্যে তাদের ঘরে ফেরাতে প্রশাসন ও পুলিশ কাজ শুরু করেছে। তবে শঙ্কা কাটছে না।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, গত ১৭ এপ্রিল বিদ্যালয়সংলগ্ন সোয়া শতাংশ জায়গায় টিনের চালা দিয়ে দোকান নির্মাণকে কেন্দ্র করে গ্রামের দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। এতে আহত হয় ১০ জন। তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে বজলুর রশিদ বুলু মিয়া (৪৮) মারা যান।
বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া ষাটোর্ধ্ব রেখা বানু জানান, মারামারির পর দুই পক্ষের পুরুষরাই পালিয়ে যায়। কিন্তু বুলু মারা যাওয়ার পর ওই পক্ষের পুরুষরা গ্রামে ফেরে। সে সময় পুলিশ উপস্থিত থাকায় তাত্ক্ষণিক কিছু হয়নি। কিন্তু রাত ১১টার দিকে তারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে হামলা শুরু করে। কোনো বাড়িতেই পুরুষ ছিল না। এই সুযোগে তারা বাড়িতে ভাঙচুরের চেয়ে বেশি চালায় লুটপাট। তিনি বলেন, ‘ও বা, যুদ্দের মদ্দেও ইংকা হয়নি। যিটি যা পাচে সব লিয়ে গ্যাচে। সোনাদানা, চাউল, দরজা-জানলা, পানির কল কিচুই বাদ থোয়নি বা। ’
গ্রামের বাসিন্দা শামীম প্রামাণিক বলেন, ‘ইসকুলের ঘরোত যায়া দ্যাকেন মানুষ ভাত খাচ্চে কলার পাতাত করে। থালা-গিলেস পর্যন্ত লুট করে লিয়ে গ্যাচে। ’
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী কেয়া মনি দিনভর স্কুল করে, রাতও যাপন করছে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে। তার মতো তৃতীয় শ্রেণির সুমাইয়া আক্তার ও ফাতেমা খাতুন, প্রথম শ্রেণির সাহারা খাতুনের আশ্রয়ও বিদ্যালয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দোকানঘর নির্মাণ ওই দিনের ঘটনা হলেও শত্রুতা দীর্ঘদিনের। স্থানীয় ইউপি সদস্য বাদশা মিয়ার সঙ্গে নারী ইউপি সদস্য এলিজা বেগমের স্বামী ইন্দাজ ফকিরের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে গ্রামবাসী হয়ে পড়ে দুই ভাগ। এখানে বাদশার পক্ষের লোকজন বিবদমান ওই জায়গায় একটি দোকান ভাঙচুর করে দখলে নিতে গেলে বাধে সংঘর্ষ। একটি খুনের পর ইন্দাজ ফকিরের সমর্থকরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাদশার পক্ষের লোকজন দোকানে হামলার ঘটনায় একটি এবং হত্যার ঘটনায় আরেকটি মামলা করে। ওই দুই মামলায় ৭০ জন আসামি। তারা মামলার ভয়ে যখন গ্রামছাড়া, সেই সময়ই হামলা ও লুটপাট হয়েছে বলে গ্রামবাসী জানায়।
নারী ইউপি সদস্য এলিজা বেগম জানান, বাদশার সঙ্গে তাঁর স্বামীর কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে তাঁরা গ্রামের মানুষের পক্ষে থাকার কারণে তাঁকে এবং তাঁর স্বামীকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় ফেরেন গত বৃহস্পতিবার। এরপর দেখেন বাড়িতে মাথা গোঁজার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। কাঁথা-বালিশ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁদের আশ্রয় নিতে হয়েছে বিদ্যালয়ে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আপাতত তাঁদের বিদ্যালয়ে থাকার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করায় তাঁদের দুটি কক্ষ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তাঁরা বাড়ি ফিরবেন বলে চেয়ারম্যান আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। ’
ইউপি চেয়ারম্যান এস্কেন্দার আলী বলেন, ‘পরিবারগুলোর বাড়িতে ওঠার মতো পরিবেশ না থাকায় ইউএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আপাতত তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন, আমি সেটি করেছি। ’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইউপি সদস্য বাদশা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর বোন পরিচয় দিয়ে সালমা খাতুন বলেন, ‘মেম্বার শহরে গেছে। ’ তাঁর মুঠোফোন নম্বর চাইলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
শিবগঞ্জের ইউএনও উম্মে কুলসুম সম্পা বলেন, ‘পুলিশকে বলা হয়েছে ওই এলাকায় যেন আর কোনো সংঘাত না হয়।
শিবগঞ্জ থানার ওসি দীপক কুমার দাস বলেন, ‘তাদের নিয়ে এরই মধ্যে বৈঠক করা হয়েছে। আর সেখানে কোনো সমস্যা হবে না বলে উভয় পক্ষ কথা দিয়েছে। ’