গত ১৩ বছর ধরে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ করে আসছে সরকার। বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দেওয়া একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু গত বছর ও এ বছর সেই ধারাবাহিকতা রাখা যায়নি। এ বছর শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ নতুন বই এখনো হাতে পায়নি। পুরাতন বই দিয়েই শিক্ষকরা কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছেন ক্লাস। রাজধানীর চারটি স্কুলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
রাজধানীর রাজাবাজারের নাজনিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সরেজমিন স্কুলটিতে দেখা যায়, নতুন বছর শুরু হলেও এখনও শিক্ষার্থীর স্কুলে সেভাবে আসা শুরু করেনি। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিখা মজুমদার বলে, আমি তিনটা নতুন বই পেয়েছি। স্যাররা ক্লাস নিচ্ছেন পুরাতন বই দিয়ে। স্যাররা বলেছেন, নতুন বই পেলেই আমাদের দেওয়া হবে।
বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই পেয়েছে জানিয়ে এই শিক্ষার্থী আরও বলে, বইয়ের কাগজের খুব একটা ভালো না। মনে হয় একটু পানি পড়লে বা টান পড়লেই ছিড়ে যাবে।
একই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলেয়া খাতুন বলে, আমি পেয়েছি দুইটা বই- বাংলা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা।
রাজধানীর শুক্রাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী সালেকিন হাসানের বাবা ওবায়দুল রহমান বলেন, ছেলের তিনটা বই দেওয়ার কথা। পেয়েছে মাত্র একটা। স্কুল থেকে বলেছে পাওয়ামাত্রই দিয়ে দেবে।
এই স্কুলের একজন শিক্ষক বলেন, আমরা আপতত পুরাতন বই দিয়ে ক্লাস নিচ্ছি। সাধারণ ধারণা দিচ্ছি। সব বই হাতে পেলে পুরোদমে ক্লাস নেয়া শুরু করব।
এই দুই স্কুলের মতো একই চিত্র ধানমণ্ডি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লালমাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। এই দুই স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে গেছে একটি-দুটি করে বই। লালমাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান মায়ের সাথে স্কুল থেকে ফিরছিল। কাঁধে ব্যাগ। জানতে চাইলে দ্বিতীয় শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর মা বলেন, ওর বড় এক ভাইয়ের দুইটা বই এনে দিছি। আর স্কুল থেকে দিছে একটা বই।
ঢাকার বাইরের চিত্রও প্রায় একই। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার রহমতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেরুন নিসা বলেন, আমাদের স্কুলে প্রথম দিন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি করে বই পেয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে দুটি করে বই।
একই উপজেলার বড়দরগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকও একই কথা বলেন। তিনি জানান, তার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও একটি-দুটি করে বই পেয়েছে।
গাইবান্ধার ঘাটারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিন একটি করে বই পেয়েছে। রাজশাহী গোদাগাড়ীর একটি স্কুলের শিক্ষক জানান, তাদের স্কুলেও শিক্ষার্থীরা একটি-দুটি করে বই পেয়েছে।
বইয়ের এই সঙ্কট নিয়ে আগে থেকেই আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। অনুমেয় ছিল প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে না শতভাগ নতুন বই।
আবার কাগজের মানে সরকার কিছুটা ছাড় দিলেও একেবারেই নিম্নমানের বই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত বছর জুড়ে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, কাগজের মৌলিক উপাদান সঙ্কট, দেরিতে কাজ শুরু করা- এমন নানা কারণে সঙ্কটে পড়ে বই বিতরণ কার্যক্রম এবং বইয়ের মান। এরমধ্যেও সরকার থেকে দ্রুত বই দেয়া হবে বলা হলেও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে ভিন্ন কথা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে চার কোটি নয় লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ৩৪ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে। এনসিটিবি বলছে, প্রাথমিকের ৮৩ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ৭৮ শতাংশ বই বিতরণ করা হয়েছে।
যদিও মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি, ঘাটতির পরিমাণ এনসিটিবির হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, প্রাথমিকের ৫০-৬০ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২০-৩০ শতাংশ বই ছাপানোই হয়নি। টেন্ডার অনুযায়ী ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও সব বই দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এবারের বই উৎসব আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেক প্রতিষ্ঠানেই বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। আশা করছি জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা বই হাতে পাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রেস থেকে আসা বইয়ের তালিকা থেকেই এই সংখ্যা বলেছি। তারা কেন কম বলছেন তা জানা নাই।
এদিকে বইয়ের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, দুই সপ্তাহের মধ্যেই সবাইকে শতভাগ বই দেয়া হবে।
যদিও বই উৎসবের দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেছিলেন, ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে।