উত্তরের জেলা বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা আদমদিঘী। সেখানকার নসরতপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম শাঁওইল। দেখে মনে হয় যেন এক শিল্পপল্লী, যার পুরোটাই তাঁত শিল্পনির্ভর। ফেলনা বা ঝুট কাপড়ের সুতোয় তৈরি হয় কম্বল, চাদর, মোজাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়। সুতা কেটেও জীবিকা নির্ভর করে শাঁওইলসহ আশপাশের অর্ধশত গ্রামের মানুষ। আর এ তাঁতপল্লীকে ঘিরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার লোকের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাঁওইল গ্রামে কয়েক দশক আগে থেকেই তাঁতিদের বসবাস। তাদের তৈরি কম্বল-চাদর কম দামে বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে। এ শিল্পের মূল কাঁচামাল গার্মেন্টের ঝুট কাপড়। ফেলনা এ কাপড় অল্প টাকায় কিনে এনে তা থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়। আশপাশের গ্রামগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেউ বংশপরম্পরায় এ কাজ করেন, কেউবা আবার উপার্জনের আশায়। তাঁতপল্লীগুলোয় পুরুষরা দৈনিক ৪০০ ও নারীরা ২৫০-৩০০ টাকায় কাজ করেন। তাদের তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য সপ্তাহের প্রতি রবি ও বুধবার গ্রামেই বসে হাট। সুতা, শীতবস্ত্র, চাদর, মোজা ইত্যাদি কিনতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ ভিড় জমায় ভোর থেকেই।
শাঁওইল হাটে সুতার কারবার করেন মো. আব্দুস সালাম শেখ। মেসার্স ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের এ স্বত্বাধিকারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার বাবাও এ কাজ করতেন। ওনার মাধ্যমেই আমার এ ব্যবসায় আসা। অফ সিজনে আমরা চার-পাঁচ টন সুতা বিক্রি করি। শীতকালে চাহিদা বাড়লে বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমরা সাধারণত ৪০-৬০ টাকায় ঝুট কাপড় কিনি। ধরন অনুযায়ী তা ৩০০-৬০০ টাকা পর্যন্তও হয়। তবে সুতা তৈরির জন্য এগুলো ডায়িংয়ের জন্য আবার ঢাকায় পাঠাতে হয়। এতে আমার সময় যেমন বেশি লাগে, খরচও বেড়ে যায়। তাই এ বাজারে (শাঁওইল হাট) একটি ডায়িং মেশিন স্থাপন করা দরকার।’
সরজমিনে দেখা যায়, শাঁওইল হাটসংলগ্ন এলাকায় বেশকিছু টিনশেডের ঘর। প্রতিটি ঘরেই কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। কেউ ঝুট কাপড় থেকে সুতা ছাড়াচ্ছেন, কেউবা চরকা থেকে সেগুলো নলিতে বা সূচিতে উঠাচ্ছেন। এ সুতা দিয়েই তারা কম্বল, চাদর, তোয়ালে, বিছানার চাদর ইত্যাদি তৈরি করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অক্টোবর থেকে জানুয়ারিতে মানুষের কর্মব্যস্ততা বেশি থাকে। কারণ সে সময় শীতপণ্যের চাহিদা বাড়ে। গ্রামের প্রতিটি মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। শীতের সময় আশপাশের প্রতিটি ঘরেই তৈরি হয় চাদর, কম্বল ও শাল। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এগুলো এখন স্বল্পমাত্রায় রফতানিও হয়।
সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও জানান স্থানীয় ব্যবসায়ী ও তাঁতিরা। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজির সংকট ও ব্যাংক ঋণে উচ্চসুদ। শাঁওইল বাজারে কেবল দুটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। এছাড়া সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ হস্তচালিত তাঁতে বা হ্যান্ডলুম দিয়ে পণ্য তৈরি করে। প্রতিটি কম্বল তৈরিতে তিনজনের প্রায় ৪০-৫০ মিনিট লেগে যায়। ফলে দিনে তৈরি করা যায় এক ডজনের মতো কম্বল। অন্যদিকে পাওয়ারলুমের উৎপাদনক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি। শারীরিক কষ্টও কম হয়। কিন্তু একেকটি পাওয়ারলুমের দাম দেড় লাখ টাকার মতো। তাই অর্থের অভাবে বেশির ভাগ মানুষ হ্যান্ডলুমেই পণ্য উৎপাদন করে।
গ্রাম উন্নয়ন ও ঋণদান সমবায় সমিতির নির্বাহী পরিচালক মো. মোফাজ্জ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এ শিল্পকে ঘিরে প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ দোকান গড়ে উঠেছে। এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। এখানে এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন থাকা জরুরি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার, যাতে আরো বেশি মানুষ এখানে কাজ করতে পারে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও ঠিক রাখা জরুরি। তা না হলে বর্ষাকালে রাস্তায় পানি জমে থাকে। হাটের দিনে দোকানিদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। আরেকটি বড় সমস্যা হলো ঋণের সুদহার।’
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বগুড়ার তাঁত শিল্পপল্লীগুলোয় বছরে ৭০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। আর এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশন এ ক্লাস্টারে কাজ শুরু করে ২০১৪ সালে। ফাউন্ডেশনের অধীনে ঋণ দেয়া হচ্ছে ৬ শতাংশ হারে।
জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মুশফিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শাঁওইল হ্যান্ডলুম ক্লাস্টারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি ডায়িং মেশিন। এছাড়া হেলথ অ্যান্ড সেফটির একটি ইস্যু আছে। সেটি নিয়ে আমরা কাজ করার পরিকল্পনা করছি। তাছাড়া এখানকার পণ্যগুলো রফতানি উপযোগী করার প্রচেষ্টা চালাব। ডিজাইনে নতুনত্ব আনতে আমরা তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ করে তুলব।’