যশস্বী জয়সোয়াল- এবারের আইপিএলে দুরন্ত গতিতে ছুটে ভারতীয় এ ব্যাটার গড়েছেন ইতিহাস। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে মাত্র ১৩ বলে ফিফটি করে টুর্নামেন্টের ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড এখন তার নামে। এই বাঁহাতির ব্যাটিং তান্ডবে কেকেআর এর ঘরের মাঠে তাদেরকে হারিয়ে প্লে অফে দৌড়ে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস।
বাইশ গজে ঝড় তোলা তরুণ এ ভারতীয় ব্যাটারকে অবশ্য শৈশব থেকেই মোকাবেলা করতে হয়েছে অনেক ঝড়। যে ঝড়ে এলোমেলো হয় জীবন, লাগাম ছুটে যায় স্বপ্নের, দ্বিধা হয় ললাটের উপর। জয়সোয়াল শুধু সেসব ঝড়ে টিকে থেকেছেন তাই ই নয়, এক মুহূর্তের জন্যও হাতছাড়া করেননি নিজের স্বপ্নের লাগাম, উলটো দ্বিগুণ অনুপ্রেরণা নিয়ে ছুটে গেছেন স্বপ্ন পূরণের নেশায়। তাই তো অন্ধকারে আজাদ ময়দানে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে দেখা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের আলো এখন ধরা দিয়েছে জয়সোয়ালের দু হাতের মুঠোয়, উদ্ভাসিত হয়েছে সফলতার গল্পে।
সংগ্রাম- বলা হয়, সব সফল মানুষের জীবনেই রয়েছে সংগ্রাম। তবে, যে বয়সে সংগ্রাম শুরু হয় জয়সোয়ালের জীবনে সে বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে পার্কে খেলতে যায় অন্য ছেলেমেয়েরা। আর এ সংগ্রামের গল্পে ক্রিকেট যেন কপালে মায়ের একে চুম্বনের মতোই মিশে আছে জয়সোয়ালের জীবনে।
ক্রিকেট যেখানে অনেক মানুষের আবেগ, ভালোবাসার নাম সেখানে জয়সোয়ালের জীবনে ক্রিকেট ছিলো বেঁচে থাকার আরেক নাম। উত্তর প্রদেশের ভাদোহি এলাকা থেকে দশ বছর বয়সে মুম্বাই চলে আসেন জয়সোয়াল ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে। বাবার সাধ্য ছিলো না মুম্বাই শহরে ছেলের খরচ যোগানোর, একমাত্র চাচা নিজের ঘরে আশ্রয় না দিতে পারলেও এক ডেইরি ফার্মে কাজ যোগাড় করে দেন। সেখানে কাজের বিনিময়ে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয় তার।
দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি, নিজের খাবার নিজে বানানো সব মিলিয়ে ক্রিকেট অনুশীলনের আর সময় কোথায়! তবুও সময় পেলেই খেলেছেন ক্রিকেট, আর তা করতে গিয়েই অনেক সময় ফার্মের সব কাজ করা হয়ে ওঠতো না। তাই এক সন্ধ্যায় বিতাড়িত হতে হয় সেখান থেকে।
বাবা-চাচা কাউকে না জানিয়ে চলে যান মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে। সেখানকার কোচ ইমরান কে থাকার জায়গা করে দেয়ার অনুরোধ করলে কোচ শর্ত দেন পরবর্তী ম্যাচে পারফর্ম করার।
প্রশ্ন যখন মাথার উপর একটু ছায়ার পারফরম্যান্স যেনো সেখানে ভালো হতে বাধ্য। পরের দিন ম্যাচে ভালো করায় ময়দানেরই পাশে এক তাবুতে থাকার জায়গা পান জয়সোয়াল। সেখানেও পোহাতে হয়েছে হাজারো ঝঞ্জাট। বৃষ্টি হলেই ময়দান ভেসে যেতো পানিতে, ভিজেপুড়েই নির্ঘুম কাটাতে হতো রাত, আলো না থাকায় অনেক রাতই কেটেছে ময়দানে শুয়ে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট এর আলো দেখে, আর ভেবেছেন একদিন তিনিও খেলবেন সেখানে।
থাকার জায়গা হলেও নিজের খরচ জোগাতে জয়সোয়াল রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করেছেন পানি পুরি। সামান্য যা আয় হতো তাই দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পড়ে চালিয়ে গেছেন অনুশীলন। এরপর একদিন তার খেলা দেখে মুগ্ধ হন কোচ জোয়ালা সিং। দায়িত্ব নেন তার অনুশীলন এর, ব্যবস্থা হয় থাকা খাওয়ারও।
এরপরের গল্প শুধুও অর্জনের। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ১৫৪ বলে ২০৩ রান করে হন ক্রিকেট বিশ্বে লিস্ট-এ ক্রিকেটে দুইশত রান করা সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার। ডাক আসে অনূর্ধ্ব -১৯ জাতীয় দলে খেলার। আর ২০২০ অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে করেন চার শত রান। সে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি রানের মালিকও ছিলেন তিনি। একই বছর ডাক আসে আইপিএল খেলারও। নিলামে আড়াই কোটি রূপিতে তাকে কিনে নেয় রাজস্থান রয়্যালস। আর এ মৌসুমে রয়্যালসের হয়েই দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড গড়েন তিনি।
আর এত সব সংগ্রাম আর ধারাবাহিক সফলতার মিছিলে এবার ধরা দিয়েছে চূড়ান্ত অর্জন। আইপিএলে ব্যাট হাতে আলো ছড়ানোয় এবার ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলে ডাক পেয়েছেন জপ্যসোয়াক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আসছে টেস্ট সিরিজের দলে আছেন তিনি। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সাদা পোশাকে তাঁর অভিষেক হবার সম্ভাবনা আছে। একই সঙ্গে রোহিত-কোহলিকে ছাড়াই ঘোষিত টী-টোয়েন্টি দলেও তাকে দলে রেখেছেন নির্বাচকরা।
শৈশবেই চরম সংগ্রামের সাথে পরিচিত হওয়া জয়সোয়াল ধৈর্য, স্বপ্ন আর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আসতে পেরেছেন এতোটা পথ। অজস্র কাঁটা ছড়ানো এ পথে হয়তো থেমে যাওয়ার কথা মনে হয়েছে কখনো, তবুও হার না মানা মানসিকতার কারণেই জয় করতে পেরেছেন এ বন্ধুর পথ।