গুলশানের একটি অভিজাত ফ্লাট থেকে সোমবার রাতে উদ্ধার করা হয় এক তরুণীর মরদেহ। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পুলিশের মনে হয়েছে এটি কোনো হত্যার ঘটনা নয়। এটি একটি ‘আত্মহত্যা’। তবে পুলিশ এটাও নিশ্চিত হয়েছে যে এই আত্মহত্যায় অন্যের প্ররোচনা রয়েছে। প্ররোচনায় কে বা কারা জড়িত সেই বিষয়ে এখন অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশ। এ ঘটনায় যে মামলার হয়েছে তাতে একমাত্র আসামি করা হয়েছে দেশের শীর্ষ এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। পুলিশ বলছে, সেই আসামির সম্পৃক্ততা পেলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
গত সোমবার রাত ১১টার পর গুলশান-১ এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট (বি/৩) থেকে ওই কলেজছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মধ্য রাতে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা হয়। দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন ভিকটিমের বড় বোন। একমাত্র আসামি করা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। ভিকটিমের লাশ উদ্ধারের পরের দিন মঙ্গলবার পুলিশের পক্ষ থেকে আনভীরের দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। আনভীর যেন দেশত্যাগ করতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকেও পুলিশ চিঠি দিয়েছে।
এদিকে সায়েম সোবহান আনভীর বুধবার আদালতের কাছে আগাম জামিনের আবেদন করেছিলেন। যদিও লকডাউনে বন্ধ রয়েছে আগাম জামিন প্রক্রিয়া। কিন্তু তারপরো আনভীর হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করেন এবং বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য তা রাখা হয়েছিল কার্যতালিকায়। কার্যতালিকায় থাকায় শুনানির এখতিয়ার ছিলো বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান বেঞ্চের। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে এখতিয়ার বাদ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন সুপ্রিম কোর্ট। এর পরপরই আদালতের দরজায় টাঙিয়ে দেয়া হয় নোটিশ। কোর্ট শুরু হলে বিচারপতিরা জানান, ভুলে এ ধরনের ১৪টি আবেদন তালিকায় এসেছিলো।
অন্যদিকে এই ঘটনায় সরকারদলীয় হুইপ ও চট্টগ্রামের একজন সংসদ সদস্যের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিকটিমের কিছু কথোপকথনের ‘স্ক্রিনশটের’ সূত্র ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে সংসদ সদস্যের ছেলে গণমাধ্যমের সাথে কথাও বলেছেন।
তিনি বলেন, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো তিনি জানিয়েছেন। জানতে চাওয়া হয় তিনি ভিকটিমকে চেনেন কি না? জবাবে তিনি জানিয়েছেন, ভিকটিমের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। গত বছর ভিকটিম ফেসবুকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে তার দাবি, ভিকটিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তার সঙ্গে কথোপকথনের যে স্ক্রিনশট ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে এই কথোপকথনগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও দাবি জানিয়েছেন তিনি।
আত্মহত্যায় প্ররোচনার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে কি না এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, তারা ২০২০–২১ সাল পর্যন্ত লেখা ডায়েরি উদ্ধার করেছেন। ওই ডায়েরিতে ধারাবাহিকভাবে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত লিখেছেন ভিকটিম। একটি পৃষ্ঠায় তিনি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন বলে লিখেছেন। কিন্তু তাতে কোনো তারিখ ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, এটা তিনি লিখেছেন ২৬ এপ্রিল এবং এতে আত্মহত্যার ইঙ্গিত ছিল। ডায়েরির একটি জায়গায় ভিকটিম তারিখ না দেয়া পৃষ্ঠাগুলো পড়ার অনুরোধ করেছেন, কোনোভাবেই যেন ওই পৃষ্ঠাগুলো কেউ এড়িয়ে না যায় সে কথাও বলেছেন। ছয়টি ডায়েরিতেই ভিকটিম তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে লিখেছেন।
এদিকে ভিকটিমের পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্ত প্রভাবশালী হওয়ায় এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার বাদি ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনকে বলেন, ঘটনার পর থেকেই তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ। ভিকটিমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা সদর উপজেলার মনোহরপুর। ভিকটিমের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা যিনি মারা গেছেন। ভিকটিমেরও মাও বেঁচে নেই। বড় বোন রয়েছেন। সোমবার সকালে বড়বোনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে শেষ কথা হয়। এই বড় বোনই বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী গুলশান থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলাটি দায়ের করেছেন।
দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যা প্ররোচনার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে অনুরূপ আত্মহত্যা অনুষ্ঠানে সহায়তাকারী ব্যক্তির ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।’ তবে বাংলাদেশে আত্মহত্যায় প্ররোচনা প্রমাণ করা বেশ কঠিন। এ ধরনের মামলায় সাজা হওয়ার ঘটনাও বিরল। আত্মহত্যায় প্ররোচনার ১৩০টি মামলা নিয়ে ২০১৮ সালে গবেষণা করে। যার মধ্যে মধ্যে ৭২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মাত্র ২ টিতে সাজা হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে আইনজীবীরা উল্লেখ করেন, ফৌজদারি অপরাধে কাউকে সাজা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধ প্রমাণ করতে হলে প্ররোচণায় সরাসরি জড়িত থাকার বিষয় প্রমাণ করতে হবে। দূরবর্তী প্ররোচনায় বা নিজে নিজে মনঃকষ্ট পেয়ে কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে কেউ প্ররোচিত করছে এমনটা বলা যাবে না। প্ররোচনার বিষয়টি হতে হবে সরাসরি – যেমন, স্বামী স্ত্রীকে বললো – ‘তুই মরে যা, তোর মুখ দেখতে চাইনা’, ইঁদুরের বিষ খেয়ে মরে যেতে পারিসনা!’ এ ধরনের সরাসরি প্ররোচনা না থাকলে আসামির মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।